প্রাণের উৎসব চারুকলায়

‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা, কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে। মধুর অমৃতবাণী, বেলা গেল সহজেই, মরমে উঠিল বাজি, বসন্ত এসে গেছে’—এমন সুরের অনুরণনে ফাগুনের প্রথম দিনে সকাল থেকেই চারুকলার মুক্তমঞ্চে শুরু হয়েছে ভালোবাসার রূপে বসন্ত বরণ।

ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে পলাশ, শিমুলসহ বর্ণিল ফুলে সেজেছে প্রকৃতি। সেই রঙের ছোঁয়া যেন লেগেছে সবার মনে। হলুদ, বাসন্তী রঙের শাড়ি, নজরকাড়া পাঞ্জাবি এবং রঙিন ফুলে নিজেকে সাজিয়ে নানা বয়সের মানুষ হাজির হয়েছেন মুক্তমঞ্চে। গানের তালে তালে চলছে নৃত্য পরিবেশনা। সেইসঙ্গে আবৃত্তি, লোকগান মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে। এ যেন এক প্রাণের উৎসব।

সকালের লাল সূর্যের ঘোর তখনও কাটেনি। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে সকাল সাতটা থেকে চারুকলায় কোলাহলের ঢামাঢোল বেজেছে। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসব’ স্লোগানে সুরের মূর্ছনার আবেশ ছড়িয়ে আছে বকুলতলা।

আবৃত্তি শিল্পী আহসান উল্লাহ তমাল ও নুসরাত ইয়াসমিন রুম্পার সঞ্চালনায় নীপেন সরকারের বাদ্যযন্ত্র ও চতুরঙ্গীতে রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে এ উৎসব শুরুর শুভ সূচনা হয়। বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পী লুম্বিনী তালুকদার, অব্যয়, ঋদ্ধি ও স্মরণিকা সাহার দ্রুপত রাগ-বাহার পরিবেশন করেন।

ভালোবাসা দিবস এবং পহেলা ফাগুন যুগলের আগমনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে সাজ সাজ রব। বসন্তকে বরণ করতে শাহবাগের ফুলের দোকান, বিপণিবিতানে লাল-হলুদের আভা। চারিদিকে হলুদের মেলা, তরুণ-তরুণীদের দেখা যাচ্ছে হলুদ, কমলা ও বাসন্তী রঙের পোশাকে। টিএসসি, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরি, অপরাজেয় বাংলা, বিজনেস ফ্যাকাল্টি, শ্যাডো, কার্জন হল, এনেক্স ভবন, শহীদ মিনারসহ পুরো এলাকায় বাসন্তী সাজ।

খোঁপায় ফুলের মালা, মাথায় ফুলের টায়রা, হাতে রেশমি চুড়ি আর পরনে বাসন্তী রঙ্গের শাড়িতে নারী, আর পুরুষদের পরনে শোভা পাচ্ছে রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া। আবছা কুয়াশাচ্ছন্ন মিষ্টি রোদও আজ উল্লাসে যোগ দিয়েছে। প্রকৃতি একান্তভাবে বরণ করে নিচ্ছে ঋতুরাজকে। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিতে বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলা জানান দেয় নতুন দিনের। শীতে খোলসে ঢুকে থাকা বনবনানী অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠে। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। আর এ সাজে মন রাঙিয়ে গেয়ে উঠবে মন, ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’।

১৫৮৫ সালে বাংলা সনে ১৪টি উৎসব প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বসন্ত বরণ উৎসবের উন্মেষ ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে। ষাটের দশকে ফাল্গুনের প্রথম ছুটির দিনে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছিল ছায়ানট। স্বাধীন বাংলায় প্রথম বসন্ত পালিত হয় ১৯৯৪ সালে। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের হাত ধরে ১৪০১ বঙ্গাব্দের পহেলা ফাগুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় উদযাপন শুরু হয় এই উৎসবের। এরপর থেকে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে এই উৎসব।

করোনা মহামারির অভিশাপ কাটিয়ে উত্তরা, ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কেও এবার যুগপৎ চলবে উৎসব। হবে বিকেলের উৎসবও।

অনুষ্ঠানে একক আবৃত্তি পাঠ করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, আহকাম উল্লাহ ও নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলি। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শামা রহমান, মহাদেব ঘোষ, অনিমা মুক্তি গমেজ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বিজন চন্দ্ৰ মিস্ত্রি, মাহমুদুল হাসান, ফেরদৌসি কাকলি, নুসরাত বিনতে নূর, নবনীতা জাইদ চৌধুরী, সঞ্জয় কবিরাজ, এস.এম মেজবা।

অনুষ্ঠানে একক আবৃত্তি পাঠ করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, নায়লা তারাননুম চৌধুরী ফাকলি।

একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ফাহিম হোসেন চৌধুরী, সালমা আকবর, লাইসা আহমেদ লিসা, প্রিয়াংকা গোপ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস ও সুচি দেবনাথ।

দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন গীতাঞ্জলি, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, বহ্নিশিখা, ও বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস (ওয়াইজঘাট)।

দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন সুরঙ্গমা, ধৃতি, স্বপ্ন বিকাশ কলা কেন্দ্র, নৃত্যম, ভাবনা, গৌড়ীয় নৃত্য সারথী, নৃত্যনন্দন, সাধনা সংস্কৃতি মন্ডল, স্পন্দন। এ ছাড়াও রয়েছে আদিবাসী চাকমাদের দলীয় নৃত্য পরিবেশনা৷

বসন্ত কথন পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ, বক্তব্য রাখেন- সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ ও সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।