আজ পহেলা বৈশাখ, বাঙালির বাঁধভাঙা উল্লাসের দিন

এসো হে বৈশাখ এসো এসো নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক এসো এসো… যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা এসো হে বৈশাখ এসো এসো। আজ নতুন আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ-সহ বাঙালি জনজাতি গ্রাম বা শহরে এই দিনটি আনন্দ ও উল্লাসের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ এ বছর রমজানের মধ্যে ও সকল স্কুল কলেজে পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ।

বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মোঘল সম্রাট আকবরের নামই বেশি শোনা যায়। তবে অনেকের মতে, বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবক সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক। পরবর্তী কালে সম্রাট আকবর সেটিকে খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশে ব্যবহার করতে শুরু করেন। আকবরের সময় প্রচলিত ক্যালেন্ডারের নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহি। ওই ক্যালেন্ডারের মাসগুলি হল, আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর ইত্যাদি। তবে কবে ও কী ভাবে এই নাম পালটে বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ হল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। মনে করা হয়, বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ।

ভারতবর্ষে মোঘল শাসনকালে হিজরি পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। এই পঞ্জিকা চাঁদের গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। এর ভিত্তিতেই কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করা হত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। স্বাভাবিক ভাবেই অসময়ে খাজনা দিতে সমস্যায় পড়তেন কৃষকরা। খাজনা শোধে কৃষকদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে কারণে বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার আনেন সম্রাট আকবর। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সম্রাট আকবরের আদেশে সৌর সন ও হিজরি সন এর ভিত্তিতে বাংলা সন তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়।

তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দে পরিণত হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা ও শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। এর পর দিন, পয়লা বৈশাখে জমি মালিকরা নিজের এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন। বিভিন্ন উৎসব আয়োজিত হত সেই উপলক্ষে।

বাংলার হিন্দুমুসলমানের সবচেয়ে সেকুলার উৎসব বাংলা নববর্ষ। হিন্দুমুসলমান সব এক, ভেদ নেই। বাঙালি। জলহাওয়া, আনাজপাতি, মাছ, গাছগাছালির ধর্ম নেই যেমন। সম্প্রতি গরু ও দুধ ‍নিয়ে ধর্মের বাহাস। ধর্ম নিয়ে সম্রাট আকবরের কোনও গোঁড়ামি ছিল না, বরং খাঁটি অসাম্প্রদায়িক। ইতিহাস তাই বলে।

বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক কে, এই নিয়ে বাঙালির এত ভাবার স্বভাব নেই। ‍ছিল না। বাংলা নববর্ষ মূলত এথনিক কালচার। বাংলার মাটি ভূমির। শহুরে কালচার নয়। গ্রামেগঞ্জে পয়লা বৈশাখের আগে চৈত্রসংক্রান্তির ‍মেলা। ‘চড়কমেলা’ নামেও অঞ্চলভেদে পরিচিত। মেলায় হিন্দুমুসলমান একত্রে সমবেত। মেলা উপলক্ষে উৎসব। নানা পসরা সাজিয়ে হাট, বিক্রিবাট্টা। গ্রামীন বাণিজ্য। অর্থনীতি। দোকানে, বাজারে হালখাতা। গতবছরের খাতায় বাকি, পাওনা, হিসেবনিকেশ। নতুন বছরে আবার শুরু।

গ্রামীন সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, কর্পোরেট ব্যবসা গিলে খাচ্ছে। আধুনিক সংস্কৃতির প্রচন্ড দাপট। হাতে স্মার্ট ফোন। গান শোনে কানে। ছবি দ্যাখে। হোয়াটসআপে, ফেসবুকে, টুইটারে যোগাযোগ। গ্রামে গাজন প্রায় বিলুপ্ত। নদীতে মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালি গান নেই। আব্বাসউদ্দীন, শচীন দেববর্মনের গান শুনতে হয় ইউটিউবে। স্মৃতি যেন উথলে ওঠে। বাংলার নদী, রূপ ক্রমশ বিলীন। পহেলা বৈশাখে, নববর্ষে এখন শহর থেকে কেউ গ্রামে যায় না। যেত গত শতকের পঞ্চাশ দশকেও। গ্রামের বাড়িতে বাবা মা আত্মীয়স্বজন অপেক্ষারত নববর্ষে শহর থেকে সন্তানাদি আসবে, সবাই পারিবারিক নববর্ষ উদযাপন। গ্রামের পরিচিত মানুষের সাথে দেখাসাক্ষাৎ, কুশলাদি বিনিময়। নানারকম খাওয়া, হরেক মিষ্টি, পিঠার আয়োজন। এবং নতুন বছরের জন্যে শুভকামনা।

বাংলার হালখাতা নিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (আর কে গুপ্ত নামেও পরিচিত। ‘সাটুল গুপ্ত’ বন্ধুকুলে)-র একটি লেখায় আছে: “গ্রামবাংলায় এবং শহরগঞ্জে হালখাতায় যার নামে বাকি নেই, তিনি বুক উঁচিয়ে চলতেন না।” হালখাতা মানেই ব্যবসায়ীর দোকানে যাওয়া। বাকি পরিশোধ, মিষ্টি খাওয়া। খেয়েদেয়ে আবার বাকি নেওয়া। হালের খাতায় নতুন হিসেব। হালখাতা।

গ্রামেগঞ্জের কিছু অঞ্চলে এখনও টিকে আছে। তাও থাকবে না। নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যবসা। বাকির বদলে নগদ। বড়ো বড়ো ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর মধ্যে ভিন্ন লেনদেন। কিস্তিতে পরিশোধ। কেউ কেউ ঋণখেলাপি। আবার দেউলিয়া।

নব্বইয়ের দশক থেকে? রমনা পার্কে (সোহরওয়ার্দি উদ্যান নামে এখন পরিচিত) ভোর থেকে তিল ধারনের জায়গা নেই। আশেপাশের রাস্তায়। মাঠেও। কেবল গানবাজনা, হরেক অনুষ্ঠানাদিই নয়, নানারকম পসরা সাজিয়ে বিক্রিবাট্টা। তাঁতের শাড়ি থেকে শুরু করে ঘুঙুর, মাটির বাসনকোশন, চুড়ি, টিপ । বাংলার ঐতিহ্যের গহনা। তৈজস। পুরুষের পরনে বাহারি পাঞ্জাবি। রঙবেরঙের মুখোশে শোভাযাত্রা। নামকরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলার এথনিক কালচারের মেলা। সমারোহ।

কার মাথা থেকে বুদ্ধি গজিয়েছিল নববর্ষের প্রথম দিনে ইলিশ পান্তা খাওয়া? রহস্য। ইতিহাসে লেখা নেই। গুঞ্জরণ এই, একজন গরিব এক হাঁড়ি পান্তা ও ইলিশ ভাঁজা নিয়ে মাঠের এক কোণে বসে সানকিতে বিক্রীর আয়োজন করে। খাদকের জটলা। চাহিদা। বিক্রেতা অসম্ভব দাম হাঁকে। হাভাতেরা চড়া দামে কেনে। খায়। পরের বছর থেকে শুরু হয় পান্তাইলিশ বা ইলিশপান্তার কালচার। ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। হুজুগে বাঙালি। নববর্ষের আগের দিনে, নববর্ষের দিনে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। পান্তাইলিশ না খেলে নববর্ষের স্ফূর্তি,যেন আমেজ নেই।

পৃথিবীর নানা দেশে মার্চের শেষে এপ্রিলের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে নববর্ষ উদযাপন হয়।

বাংলাদেশে উগ্রবাদী ইসলামিক মৌলবাদীরা জিগির তুলেছে, নববর্ষ হিন্দু কালচার। মেয়েরা কপালে টিপ পরে, হিজাব পরে না মাথায়, অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ইত্যাদি। ধর্মের লেবাসে, রাজনীতির মোড়কে বাংলার এথনিক কালচার, হিন্দুমুসলিম মিলন নস্যাতে গভীরগোপনে তৎপর।

পহেলা বৈশাখের ইংরেজি তারিখ নিয়ে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গে ঝামেলা। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল, পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল। ঢাকার বাংলা একাডেমির বাংলা তারিখ-মাস-বছর বিশেষজ্ঞরা বিস্তর ঘেঁটে ঠিক করেছেন এপ্রিলের ১৪ তারিখই বাংলার নববর্ষ। লেখালেখি করে জানিয়েছেন তারিখ নির্ভুল। পশ্চিমবঙ্গের পাঁজি পুঁথি ইতিহাসবিদকুল কেন ১৫ এপ্রিল আঁকড়ে আছেন, বাংলাদেশের ১৪ তারিখ কেন খণ্ডন করছেন না, চুপ, প্রশ্ন উঠছে। বাংলা নববর্ষের সঠিক তারিখ নিয়েও রাজনীতি? পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ব রাজনীতি? বাংলাদেশের মুসলিম রাজনীতি? এথনিক কালচারের রাজনীতি? দুই বাংলার এথনিক কালচারে, মানবমিলনে।

নববর্ষে ব্যবসায়ীরা সকল ধরনের দেনা বাকি মওকুফ করে নতুন ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে। তখন থেকেই মূলত এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় এবং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষকে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পালন করা হচ্ছে।