তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, বন্ধ চলাচল

মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ। গত রোববার থেকে নেই বিদ্যুৎ। সড়ক যোগাযোগেও লাগাম। শহরে থইথই পানি, মানুষ ঘরবন্দি। পাহাড়ের ঢালে যাদের বাস, তাদের মনে ভীতি। অনিন্দ্যসুন্দর বান্দরবান নেই চেনা রূপে। অবিরাম বৃষ্টিতে যেন তছনছ এক জনপদ। টানা চার দিনের প্রবল বৃষ্টিতে থমকে গেছে জীবন। বান্দরবান শহরের ৬০ শতাংশ প্লাবিত হয়েছে বলে খোদ জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনেই বলা হচ্ছে। ভয়াবহ এ দুর্যোগ মোকাবিলায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনী জরুরি সভা করেছে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের পানিবন্দি মানুষও আছে দুর্বিষহ যাতনায়। আরও দুই পাহাড়ি জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িও বিরামহীন বারিধারায় বিপর্যস্ত। পর্যটননগরী কক্সবাজারে একই রকম নাজুক পরিস্থিতি। সেখানকার চার লাখ মানুষ জলের সঙ্গে লড়ছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় ডুবে আছে অসংখ্য বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কারখানা। ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা। আগামীকাল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্যাহত হচ্ছে বন্দরের কার্যক্রম। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে কোমরপানি। এর ফলে সেই পথে চলছে না যান। আটকে গেছে শত শত গাড়ি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নতুন রেলপথের কিছু অংশও পানিতে ডুবে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় রাঙামাটির সাজেকে আটকা পড়েছেন কয়েকশ পর্যটক।

অন্য উপকূলীয় এলাকায় নদীপাড়ের ঘরবাড়ি ও নিচু সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় টানা দু’দিন নেই বিদ্যুৎ। পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দাদের মাঝে ভর করেছে মৃত্যুভয়। পাহাড় ধসে পড়তে পারে– এমন আতঙ্কে যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। মাইকে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। সব মিলিয়ে পাহাড়জুড়ে এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। হাল এতটাই খারাপ, গতকাল সেনাবাহিনীকে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বিপর্যয় মোকাবিলায় নামতে হয়েছে। দিনভর তারা পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার, স্বাস্থ্যসেবা ও ত্রাণের প্যাকেট সরবরাহ করেন। মাঠে কাজ করছে নৌবাহিনী ও বিজিবি। গত দু’দিনে পাহাড়ধস ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১৪ জন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শক্তিশালী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সাগরে এক সপ্তাহ ধরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখানো হচ্ছে। এবার ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় বিপদের আভাস পেয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সব নদীবন্দরকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়াবিদ তরিকুল নেওয়াজ কবির বলেন, আকাশের মেঘ ও ভারী বৃষ্টি এবার বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে সরে উত্তরাঞ্চলের দিকে এগোচ্ছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে বগুড়ায় ২০৩ মিলিমিটার। আর বান্দরবানে ১২২ মিলিমিটার ও চট্টগ্রামে ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

 

টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু নদী ফেঁপে ওঠায় বান্দরবান শহরের মানুষ পানিবন্দি। কিছু জায়গায় পাহাড় ধসের কারণে জেলা থেকে উপজেলা ও দূরপাল্লার সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে আছে। এ অবস্থায় বান্দরবান ‘কার্যত বিচ্ছিন্ন’। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। জেলার কোথাও কোথাও শনিবার রাত থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। বান্দরবান শহরের ফায়ার সার্ভিসসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে এরই মধ্যে দুই-তিন ফুট পানি উঠেছে। সড়কে পানি ওঠায় রোববার সকাল থেকে বান্দরবান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ির পথে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া জেলা শহর থেকে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ২২০ সেন্টিমিটার ও সাঙ্গু নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রশাসন সূত্র বলছে, জেলার বিভিন্ন এলাকার আট হাজার পরিবার পানিবন্দি। এদিকে পাহাড় ধসে প্রায় ৪৫০টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সাড়ে ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২০৭টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এরই মধ্যে ৮৫ টন খাদ্য এবং ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরও ত্রাণ বরাদ্দ চেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে।

 

ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় কয়েক দিন ধরে ভাসছে চট্টগ্রাম। গতকাল বৃষ্টি কম হওয়ায় নগরে জলাবদ্ধতা কিছুটা কমে আসছে। তবে এখন পানি বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে এসব জেলা-উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা পানিতে ভাসছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে চন্দনাইশের আঞ্চলিক সড়কে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার আরও অনেক সড়কে পানি ওঠায় সেসব সড়কেও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এদিকে বন্যার পানিতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়াসহ প্রায় সব উপজেলায় কমবেশি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসব উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পুকুর ডুবে বেরিয়ে গেছে মাছ। শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে; দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে দেড় লাখের বেশি গ্রাহক। খুঁটি ভেঙে ও সংযোগ লাইনের ওপর গাছ পড়ায় সংযোগ বন্ধ রাখার কথা জানাচ্ছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম জেলায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন; আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৭৫৩ জনকে। এখন পর্যন্ত প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার।

টানা সাত দিনের বৃষ্টিতে রাঙামাটিতে বড় কোনো পাহাড় ধসের ঘটনা না ঘটলেও দুই শতাধিক স্থানে ছোট-বড় ধস ও ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত জেলার ২৩৫ স্থানে এসব ভাঙন বা ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, এসব ধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৮১টি বসতঘর। যার মধ্যে রয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০টি ঘরও। এসব ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না হলেও আহতের সংখ্যা ১০।

গতকাল সকালেও শহরের রিজার্ভমুখসহ কয়েকটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পাহাড়ের মাটি বসতঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানার একটি দল দ্রুত সেখানে পৌঁছে ১৭টি পরিবারের ৬০ জনকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যায়। জেলার ২৪২ আশ্রয়কেন্দ্রে এ মুহূর্তে অবস্থান করছে সাড়ে তিন হাজার মানুষ। এ ছাড়া ভারী বৃষ্টির কারণে জেলার বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল ও কাপ্তাইয়ের বেশ কয়েকটি নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। যেখানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩০ হাজার মানুষ।
তীব্র স্রোতের কারণে কর্ণফুলী নদীতে বন্ধ হয়ে গেছে ফেরি চলাচল। সড়কে পাহাড় ধসে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদুর সঙ্গে দীঘিনালা উপজেলা হয়ে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ।

 

টানা ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে খাগড়াছড়ির নিচু এলাকা। দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বেইলি ব্রিজ, সাজেক সড়কের কবাখালী বাজার, লংগদু সড়কের বড় মেরুং, মেরুং বাজার ও দাঙাবাজার এলাকার সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিতে ডুবে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সড়কের একটি কালভার্ট ডুবে যাওয়ার কারণে সাজেক-খাগড়াছড়ি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

 

কক্সবাজারের সাত উপজেলাতেই এখন বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এসব উপজেলার অন্তত চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছু এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। ভারী বর্ষণে উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে ভূমিধসের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১০ আশ্রয়শিবিরের ১১৯টি স্থানে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজারো রোহিঙ্গার বসত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

বৈরী আবহাওয়ায় গত সোমবার চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড়ধস ও পানিতে ডুবে ৯ জনের মৃত্যুর পর গতকাল মারা গেছেন পাঁচজন। বান্দরবানে পাহাড় ধসে এক ‍কিশোরীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ১৫ বছর বয়সী সাবেকুন নাহার বেগমের লাশ উদ্ধার করা গেলেও তাঁর মা নূরনাহার বেগম এখনও নিখোঁজ আছেন। সোমবার দুপুরে বান্দরবান পৌরসভার কালাঘাটা গোধারপাড় এলাকায় এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা নার্গিস সুলতানা।
বরিশালে টানা বৃষ্টির মধ্যে একটি রেইনট্রি গাছ উপড়ে অটোরিকশার ওপর পড়ে মো. মনিরুল ইসলাম (৪৭) নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও চার যাত্রী। সোমবার রাত ১২টার দিকে বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের চাঁদের হাট খান বাড়ির সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কক্সবাজারের রামুতে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশু এবং পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রামুর রাজারকুল ইউনিয়নের মৌলভীপাড়ায় শিশুটির এবং পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিণাফাঁড়ি এলাকায় ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দুই ইউএনও। নিহত শিশুটির নাম সামিয়া (২)। সাপের কামড়ে নিহত ব্যক্তির নাম নাছির উদ্দিন (৫৫)। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বানের পানিতে ডুবে মারা গেছেন বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জুনায়েদ ইসলাম জারিফ (২২)। নিখোঁজ রয়েছেন এক ব্যবসায়ী।