স্পোর্টস ডেস্ক: রাশিয়া বিশ্বকাপের এ পর্যন্ত সেরা খেলোয়াড় কে? হ্যারি কেন, রোমেলু লুকাকু, কিলিয়ান এমবাপে, ডেনিস চেরিশেভ, এডিনসন কাভানি-গোল কারিশমা দেখিয়ে আলো ছড়িয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এদের কেউ নন, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন পয়েন্টের মানদণ্ডে সেরার মুকুটটা পরিয়ে দিচ্ছে সেই নেইমারের মাথায়, যাকে ‘অভিনেতা’র তকমা পরিয়ে তুলোধুনো করা হচ্ছে। হ্যাঁ, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নেইমারই এখনো পর্যন্ত রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা। এমনকি সময়ের সেরা দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর চেয়েও নেইমার অনেক এগিয়ে।
যুক্তি হিসেবে অনেকেই বলতে পারেন, মেসি-রোনালদোর দল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েছে, নেইমারের দল টিকে আছে। কাজেই মেসি-রোনালদোর তুলনায় নেইমার এগিয়ে তো থাকবেনই। কিন্তু বিচারের মানদণ্ডটা দ্বিতীয় রাউন্ড বা শেষ ষোল’র ম্যাচ পর্যন্তও। যে পর্বে খেলেছেন মেসি-রোনালদোও। সুতরাং বিচারের আওতায় মেসি-রোনালদোও পড়েন। কিন্তু পারফরম্যান্সের নিত্তিতে রাশিয়া বিশ্বকাপে নেইমারের কাছে হেরে গেছেন সময়ের সেরা দুই মহাতারকা।
সমালোচনা করে বলা হচ্ছে, গায়ে বাতাস লাগলেই মাটিতে পড়ে যান নেইমার। এরপর শুরু করে দেন মারাত্মক ব্যথা পাওয়ার অভিনয়। যার ভিত্তিতে ‘পাক্কা অভিনেতা’র খেতাবই পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার গায়ে। হ্যাঁ অভিনয় হয়তো কিছুটা করেন। তবে পরিসংখ্যান কিন্তু নেইমারের পক্ষেই কথা বলছে।
নেইমারের এই মাটিতে পড়ে যাওয়ার বিষয়ে পড়ে আসছি। তার আগে জেনে নিব, সেই সব পয়েন্টগুলো, যা নেইমারকে দিচ্ছে সেরার সার্টিফিকেট। ছোঁয়ার আগেই পড়ে যাওয়ার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, পরিসংখ্যান বলছে, সেই নেইমারই প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ২৩টি শট নিয়েছেন নেইমার। আর কোনো খেলোয়াড়ই প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট লক্ষ্য করে এত শট নিতে পারেননি। এই ২৩ শটের ১৩টি শট তিনি নিয়েছেন প্রতিপক্ষের গোল মুখে। মানে অন টার্গেটে। এখানেও নেইমার সবার উপরে।
এর চেয়েও বড় কথা, ব্রাজিলের এই ৪ ম্যাচেই নেইমার খেলেছেন দলের হয়ে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রমণ সানিয়েছেন তিনিই। সতীর্থদের জন্য তিনিই গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন সর্বোচ্চ ১৬ বার। নেইমার সবার সেরা ফুটবলের সবচেয়ে সৌন্দর্যের দিক ড্রিবলিংয়েও। বারবার মাটিতে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ৪ ম্যাচে তিনি সর্বোচ্চ ৩৫টি সফল ড্রিবলিং করেছেন। সমান ৪টি করে ম্যাচ খেললেও ড্রিবলিংয়ে মেসি-রোনালদোও তার ধারের কাছেও নেই।
এবার আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। নেইমার হয়তো ব্যথাপ্রাপ্তির অভিনয় একটু বেশিই করেছেন বা করছেন। কিন্তু তার বারবার মাটিতে পড়ে কাতরানোর বিষয়টি বাস্তবতাও। এই আসরে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফাউলেল শিকার হয়েছেন তিনিই। রেফারির বাঁশি বাজানোর ভিত্তিতেই ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ২৩ বার প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ট্যাকলের শিকার হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে অন্তত ১০টি ট্যাকল ছিল খুবই বিপদনজনক। রেফারি ফাউল দেননি, এমন ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার।
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ঘটেছে। ঘটেছে গত রাতে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচেও। মাঠের বাইরে গিয়ে নেইমারের পায়ে যেভাবে বুট দিয়ে পারা মেরেছিলেন মেক্সিকান ডিফেন্ডার, তা নিশ্চিতভাবেই কার্ডপ্রাপ্তির অপরাধ। কিন্তু রেফারি কোনো শাস্তিই তাকে দেননি। এমননি নেইমারের পক্ষে ফাউলের বাঁশিও বাজাননি। কি জানি, নেইমারের ‘অতি-অভিনয়’ বদনামের কারণেই হয়তো রেফারির ‘বিশেষ ক্ষমা’ পেয়েছেন মেক্সিকান ডিফেন্ডার!
যাই হোক, প্রতিপক্ষের ট্যাকল-বাধা তিনি যেভাবেই সামলান, আসল কাজটা যে ঠিকঠাক মতোই করেছেন, উপরের তথ্যগুলোই তার প্রমাণ। প্রতিপক্ষের বাধার জাল ছিঁড়ে ঠিকই দলের খেলাটা তৈরি করেছেন। আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। করেছেন গোলও।
মেসি-রোনালদোর চেয়ে তিনি যে একটা জায়গায় আলাদা, নেইমার সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন মেক্সিকোর বিপক্ষে শেষ ষোল’র ম্যাচে। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে মেসি-রোনালদো নিজেদের দলকে হারতে দেখেও উদ্ধার করতে পারেননি। এবারও তাদের বিদায় নিতে হয়েছে বিশ্বকাপের নকআউটপর্বে গোল করতে না পারার অপবাদ গায়ে মেখেই।
দুজনেই মোট ৪টি করে বিশ্বকাপ খেলেছেন। কিন্তু নকআউটপর্বের ম্যাচে কখনোই তারা গোল করতে পারেননি। কালকের আগ পর্যন্ত এই অপবাদ ছিল নেইমারের গায়েও। তবে নেইমার এর আগে একবারই বিশ্বকাপ খেলেছেন। ২০১৪ সালে নিজেদের ঘরের মাটির বিশ্বকাপের নকআউটপর্বে তিনি খেলেছেনও মাত্র দুটো ম্যাচ। এর মধ্যে কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে আবার মাঠ ছাড়তে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে। মানে নকআউটপর্বে পুরো দুটো ম্যাচও তিনি খেলেননি।
যাই হোক, সেই দুই ম্যাচে তিন গোল করতে পারেননি। এবার নকআউটপর্বের প্রথম ম্যাচেই সেই অপবাদ মুছে ফেলে নিজেকে মেসি-রোনালদোর ফ্রেম থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। তাছাড়া গতকাল শেষ ষোল’র ম্যাচটি তিনি শুধু গোলই করেননি, বলতে গেলে মেক্সিকো হেরে গেছে তার একার কাছেই।
নেইমার পারবেন, নিজের এই ‘সেরা রূপ’ অব্যাহত রেখে ব্রাজিলকে আরও এগিয়ে নিতে?