রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে সচেতনতা প্রয়োজন 

কক্সবাজার : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশটিই ছিল গর্ভবতী। রোহিঙ্গা নারীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার শিশু। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেটে গেছে প্রায় দশ মাস। কিন্তু শিশুজন্মের সে হার কমেনি। মিয়ানমারের প্রতিকূল পরিবেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জন্মগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ছিল সন্তান নেয়ার হার।
বালুখালী, কুতুপালং, ময়নারঘোনা, তমব্রু জিরো পয়েন্ট ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারই ৮-১২ সদস্যের।

প্রতিটি দম্পতিরই রয়েছে ৫ থেকে ১০টি সন্তান। মিয়ানমারের বাস্তবতায় তাদের এ জন্মহার ও প্রবণতার পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করানো হয়। বর্তমানে তারা জাতিগত নির্মূলের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু ক্যাম্পজীবনেও তাদের মধ্যে কমছে না অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতা। ফলে প্রতিদিনই অর্ধশতাধিক শিশু জন্ম নিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এতে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বাড়ছে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর এ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় রোহিঙ্গা পুরুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি।

ইউনিসেফ সমপ্রতি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, নয় মাস আগে সংকট শুরুর পর থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম হয়েছে ১৬ হাজারের বেশি শিশুর। এদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছে মাত্র তিন হাজার শিশুর জন্মে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দৈনিক জন্ম নিচ্ছে ৬০ শিশু। ওদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে কাজ করেন এমন একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আনওয়ান্টেড প্রেগনেন্সির সংখ্যা অনেক। তাদের অনেকেরই স্বামী নেই, কিংবা বিয়েই হয়নি কিন্তু গর্ভে পালন করছে বাচ্চা। চিকিৎসকরা জানান, এই আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্সির সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যে অল্প বয়সে বিয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। স্বভাবগতভাবেও অধিক সন্তান জন্মদানের পক্ষে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। তারা মনে করেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পাপ। তারা মনে করেন, যিনি সৃষ্টি করবেন, তিনিই আহার দেবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরগুলোতে অধিক সংখ্যক সদস্যের পরিবার খাবার থেকে মাথাগোঁজার ঠাঁই নিয়ে খাচ্ছেন হিমশিম। বৃষ্টি নামলেই ভিজে একাকার হয় ঝুপড়ি ঘরগুলো। রোদ উঠলে পলিথিনের গরমে সেখানে থাকা দায় হয়ে পড়ে। অত্যধিক গরম, ঘনবসতি, জলসংকটে নিয়মিত গোসলের অসুবিধার কারণে চর্মরোগসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব লেগে আছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তারপরও পরিবর্তন ঘটছে না মানসিকতায়।

বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর হোসনা বেগম চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ড্যাব-এর ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, মেটারনাল, চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারে। তার কোলে একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকন্যা। হাসপাতালের টুলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ৩-৮ বছর বয়সী আরো তিনটি ছেলেমেয়ে। বর্তমানে তিনি ৫ মাসের গর্ভবতী। একাধিক সন্তানের ব্যাপারে তিনি বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেলে পাপ হয়।

তার স্বামী তাকে সেটাই বলেছে। তিনি আল্লাহকেও ভয় পান, স্বামীকেও ভয় পান। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন করেননি। তার পাশেই নেকাবে মুখ ঢেকে বসেছিলেন আসমা বেগম। ৮ মাসের গর্ভবতী আসমার কোলে আসবে তৃতীয় সন্তান। তিনি বলেন, আমি বলেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী রাজি হয়নি। স্বামীকে নাখোশ করে আমি কীভাবে ওষুধ খাবো? ময়নারঘোনা ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর আয়শা বেগম একই ক্যাম্পে দুইমাস আগে বিয়ে দিয়েছেন তার এক মেয়েকে। তাদের ঝুপড়ি ঘরে ১১ জনের বসবাস। এখনো তিনি গর্ভবতী।

রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেন এমন দুই চিকিৎসক সিফাত ও আসিফ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানবেতর এ জীবনের মাঝেই তাই জন্ম নিচ্ছে নতুন জীবন। এ নতুন শিশুর জন্য যেমন চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন তেমনিভাবে প্রসূতি মায়ের জন্যও প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার ও চিকিৎসা। কিন্তু শরণার্থী জীবনে এসবের টানাপড়েন হয়। খাবার আর বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যেখানে কষ্টকর একটা ব্যাপার সেখানে অন্য সব ব্যাপার আর মুখ্য হয়ে ওঠে না।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, এভাবে যদি রোহিঙ্গা শিবিরে নতুন মুখের আগমন ঘটতে থাকে তাহলে তা সার্বিক অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপরে চরম চাপ তৈরি করবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে এবং সে লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করে যেতে হবে।

বালুখালীতে ড্যাব-এর ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, মেটারনাল, চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারের মিডওয়াইফ লিপি আক্তার নিয়মিত রোহিঙ্গা নারীদের এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাউন্সেলিং করেন। প্রতিটি সপ্তাহেই তিনি ক্যাম্পেইন করতে যান ক্যাম্পে। লিপি বলেন, আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছিল সর্বক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ। নিজ দেশে তারা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়েছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ বলে যে একটি বিষয় রয়েছে সেটার সঙ্গে তারা তেমন পরিচিত নয়। বাংলাদেশে আসার পর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে এ বিষয়টি জানতে ও বুঝতে পারছেন। লিপি বলেন, প্রথমদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তারা একেবারেই অনাগ্রহী ছিল। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। এখন রোহিঙ্গা নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহ প্রকাশ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

ড্যাবের মহাসচিব প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা পুরুষরাই প্রধান প্রতিবন্ধক। তারা তাদের স্ত্রীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেন। ধর্মের ভয় দেখান। এমনকি মারধর ও বহুবিবাহের ঘটনাও ঘটে ক্যাম্পে। তিনি বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের শতভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার বিকল্প নেই। আর সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নারীদের চেয়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের মধ্যেই সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা। এ জন্য সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়মিত ক্যাম্পেইন, কাউন্সেলিং করতে হবে। ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, কেবল জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিলি করলেই হবে না সেগুলো ব্যবহারে তাদের উৎসাহিত করতে হবে।

মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণের পন্থাও অবলম্বন করতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ করা কেন দরকার সে সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে নারীদের ধারণা দিতে হবে অতিরিক্ত গর্ভধারণ কীভাবে তাদের জন্য শারীরিক জটিলতা তৈরি বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। রোহিঙ্গা পুরুষদের সচেতন করতে হবে শরণার্থী জীবনে যেখানে খাবার, পানি, চিকিৎসাসহ নানা সংকট রয়েছে সেখানে নতুন শিশুর জন্মদান কেন ঠিক নয়। তাদের বুঝাতে হবে, সন্তান জন্ম দেয়াটাই বড় কথা নয়। তাকে মানুষ করে তোলাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু শরণার্থী জীবনে তা কি আদৌ সম্ভব? তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত একজন চিকিৎসক। তিনি বলেন, আরাকানে রোহিঙ্গাদের সন্ধ্যার মধ্যে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে হতো। সেখানে তাদের জীবনে কোনো বিনোদন ছিল না। স্ত্রী সঙ্গই ছিল রোহিঙ্গা পুরুষদের একমাত্র বিনোদন। তার ওপর সান্ধ্য আইনের কারণে সারা রাত বাড়িতে থাকতে হতো। ফলে তাদের মধ্যে জন্মহার বেশি। অন্যদিকে বার্মিজ সেনাবাহিনীর ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে প্রতিবছরই গর্ভধারণ করতেন রোহিঙ্গা নারীরা। দশকের পর দশক ধরে এমন পরিস্থিতি চলে আসায় বছর বছর সন্তান জন্মদানকে তারা প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বিশ্বাস করে। এখন সে বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটাতে, বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া ও অব্যাহত কাউন্সেলিং দরকার।