পাহাড়ে ১০ মাসে প্রাণ গেলো ৩৩ জনের

খাগড়াছড়িতে গুলিতে ছয়জনের মৃত্যুপাহাড়ে সংঘাতে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের হিসাবে, গত ১০ মাসে একের পর এক হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় অন্তত ৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায়ই থানায় কোনও মামলা হয়নি।

সর্বশেষ শনিবার (১৮ আগস্ট) সকালে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে একটি কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হতে থাকা ইউপিডিএফ সদস্যদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এলোপাতাড়ি গুলিতে ছয় জন নিহত ও তিন জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ কোনও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। স্বনির্ভরসহ আশপাশের এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। চলাচল করছে না খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের যানবাহন।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র নিরন চাকমা বলেন, ‘জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের নেতা তারিন্দ্র লালের (পেলে) নেতৃত্বে এই হামলা ঘটেছে বলে আমার প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। এলাকাবাসীকে নিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আজ সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সেই কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হতে থাকা দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে এবং তাদের কেউ ধরার চেষ্টাও করেনি।’

অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস (এমএনলারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ‘ইউপিডিএফ হচ্ছে চুক্তিবিরোধী সংগঠন। তারা সব সময় পাহাড়কে অশান্ত রাখতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। আজ শনিবার (১৮ আগস্ট) যা হয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এটা হয়েছে। একটি কমন বিষয় হলো, যাই ঘটুক ইউপিডিএফ মুখস্থভাবে আমাদের দায়ী করে। আমরা সন্ত্রাসী সংগঠন না এটা পাহাড়ে বসবাসরত সবাই জানে। এই ঘটনায় কোনোভাবেই আমাদের সংগঠনের কেউ ছিল না।’

২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশের পর থেকেই পাহাড়ে নাটকীয়ভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েছে চলছে। এসব হত্যাকাণ্ডে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ এর ১৬ নেতাকর্মী-সমর্থক আজকের ঘটনাসহ ২২ জন ও জেএসএস (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ১৬ নেতাকর্মী খুন হন।

গত ৩ মে রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা খুন হন। শক্তিমান চাকমা ছিলেন দলটির অন্যতম প্রধান নেতা। শক্তিমান হত্যার পরের দিন তার দাহক্রিয়া যোগ দিতে যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) সহ ছয় জন নিহত হন। প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসের মাথায় দলীয় প্রধানকে হারিয়ে অনেকটা অস্তিত্বের সংকটে ছিল ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। এসব ঘটনার পর আগে ও পরে আরও তিন গ্রুপের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে হারায় তিনটি সংগঠনই। পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনগুলোর মধ্যে একমাত্র সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি এখন কোনও ঝামেলায় না জড়ালেও বাকি তিন সংগঠনের মধ্যে প্রায়ই হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলছে।

রাঙামাটি গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. পারভেজ জানান, ‘গত এক বছরেরও কম সময়ে রাঙামাটিতে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সংঘোতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। এক মধ্যে শুধু একটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। বাকি কোনোটারই মামলা হয়নি।’

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, ‘পাহাড়ের যে সংগঠন আছে চারটা তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। নির্বাচন সামনে আসছে। সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে নির্বাচনের আগে নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি থাকতে পারে।’ তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশসহ বিশেষ শাখার লোকজনকে সহিংসতা রোধে ও নজরদারি রাখার ক্ষেত্রে সতর্কভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।