কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্ট থেকে আয় ২০০ কোটি টাকা!

রাজধানীতে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাড়ের রমরমা ব্যবসা। কোরবানি পরবর্তী সময়ে পশুর উচ্ছিষ্ট নিয়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকা।

গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশুর বর্জ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৭০ কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, চলতি বছর এর পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর এ ব্যবসায় ব্যস্ত সময় কাটছে নগরীর হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার পশুর হাড়ের ব্যাপারীদের।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি সূত্র জানায়, একসময় কোরবানি দেওয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অন্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলি ও চর্বি ফেলে দেওয়া হতো। কিন্তু এগুলো এখন আর ফেলনা নয়। এসব বর্জ্য থেকেই হচ্ছে কোটি টাকার বাণিজ্য। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জাপান ও চীনে গরু-মহিষের লিঙ্গ অত্যন্ত দামি বস্তু। এ দিয়ে তৈরি স্যুপ ওই সব দেশে খুবই জনপ্রিয় ও দামি খাবার। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে পশুর একেকটি লিঙ্গ ৮-১০ ডলারে বিক্রি হয়। এ ছাড়া গরু-মহিষের দাঁত ও হাড় থেকে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কাভার।

সূত্র মতে, পশুর হাড় দিয়ে ক্যাপসুলের কাভার, মুরগি ও মাছের খাবার, জৈব সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরি হয়। নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের খুর দিয়ে অডিও ভিডিওর ক্লিপ, অন্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুল। গরুর রক্ত শুকিয়ে ব্লাড মিল তৈরি করা যায়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং সরবরাহ করা হয়।

রাজধানীতে রয়েছে পশুর বর্জে্যর বিশাল বাজার। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে রয়েছে দুটি বাজার একটি জিঞ্জিরায়, অন্যটি হাসনাবাদ এলাকায়। আগে কেবল ঢাকার আশপাশ থেকে এই বাজারে শিং ও হাড় এলেও এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এই বাজারে আসছে গরু-মহিষের শিং ও হাড়। এখানে প্রতি মণ শিং ৬০০ টাকা ও প্রতি মণ হাড় বিক্রি হয় ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা দরে। তা ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন টাকা কেজি দরে পশুর হাড়, ২০-৩৫ টাকা দরে পশুর অন্ডকোষ, ১২০ টাকা দরে পাকস্থলি, শিং ১০০ টাকা, চোয়ালের হাড় তিন টাকা কেজি দরে কিনে নেন ব্যবসায়ীরা।

হাজারীবাগের ব্যবসায়ী এম আলম বলেন, বছরে একবারই এ ব্যবসাটা করি। বহুল প্রচারিত নয়, তারপরেও ভালো দাম পাই বলে বছরে একবারই এসব সংগ্রহে নামি। আমরা এগুলো সংগ্রহ করে কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিক্রি করি। এগুলো কেনার জন্য লোকজন আসেন। তাই বিক্রিতে ঝক্কি-ঝামেলা নাই, দাম ভালো। তবে গরুর হাড়, শিং, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রনালি, চর্বি, রক্তের মতো বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এগুলো দেশেই কাজে লাগানো যেত। দুই মণ ওজনের প্রতিটি গরু থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরির জন্য ২০ কেজি বর্জ্য তৈরি হয়। অন্ডকোষ ও গোল্লা (ভুঁড়ি) রপ্তানি হয়। প্রতিটি অন্ডকোষের রপ্তানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার ও গোল্লার মূল্য ১০-১২ ডলার। পশুর বর্জে্যর বড় বাজার হলো থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন ও জাপান।

তিনি বলেন, স্থানীয় ওষুধ শিল্পের জন্য হাড়ের চাহিদা রয়েছে। এগুলোকে হাজার কোটি টাকার সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। সরকারের পাশপাশি ওষুধ উৎপাদনকারী বেক্সিমকো, অপসোনিনসহ স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসলে পরিবেশ দূষণমুক্তের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০১৭ সালে) ১৭০ কোটি টাকার পশুর হাড়, যৌনাঙ্গ ও গোল্লা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুধু কোরবানির পশু থেকে এক হাজার মণ হাড়, ছয় হাজার কেজি লিঙ্গ ও ৫০০ মণ গোল্লা (নাড়িভুঁড়ি) সংগ্রহ করা হয়েছিল। সাধারণভাবে সমিতি সারা দেশ থেকে মাসে আড়াইশ’ মণ হাড় সংগ্রহ করতে পারে। সেই হিসাবে বছরজুড়ে সংগ্রহ করা হাড়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে কোরবানির সময়। এ কারণে এ সময় বর্জ্য সংগ্রহে লোকবল বাড়ানো হয়।

মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, পশুর বর্জ্য-হাড়, শিং, চামড়া, ভুঁড়ি, অন্ডকোষ, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত রপ্তানিযোগ্য। অধিকাংশই রপ্তানি হয় চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে।

তিনি আরো বলেন, এ বছর সার্বিকভাবে পশুর উচ্ছিষ্ট থেকে আয় ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

কেরানীগঞ্জের হাড় ব্যবসায়ী মো. সাব্বির হোসেন জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু ও মহিষের অন্ডকোষ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি অন্ডকোষের রপ্তানি মূল্য ৮ থেকে ১০ ডলার।

জানা গেছে, কারখানাগুলোয় প্রথমে হাড় শুকিয়ে গুঁড়ো করা হয়। হাড়ের গুঁড়ো ক্যাপসুলের আবরণ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি হাড় ও হাড়ের গুঁড়ো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গরু, মহিষ ও ছাগলের শিং ভারতে রপ্তানি হয়। শিং দিয়ে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করেন ভারতের কারিগররা। এ ছাড়া হাড়ের গুঁড়ো দিয়ে স্থানীয়ভাবে মুরগির খাবার এবং জৈব সারও তৈরি করা হয়।

ওষুধ কোম্পানিগুলো পশুর গলা, পাঁজর ইত্যাদি অংশের হাড় কেনে। সেগুলো দিয়ে ক্যাপসুল বানানো হয়। মাথার হাড় দিয়ে মেলামাইন তৈরির পাশাপাশি মাছ ও মুরগির খাবার তৈরি এবং অন্যান্য কাজ করা হয়। পশুর শিং দিয়ে তৈরি হয় চিরুনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর দ্রব্য ইত্যাদি। এসবের অধিকাংশ আবার তৈরি হয় দেশের বাইরে। আগে হাজারীবাগেই ভাঙা হাড় থেকে চিরুনি তৈরির একাধিক কারখানা ছিল।

আবিদান ব্রাদার্সের প্রোপাইটার মিয়া জানান, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় এ কারখানাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন সৈয়দপুরে কয়েকটি হাড় প্রক্রিয়াকরণ কারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানে চিরুনিসহ অন্য হাড়জাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। গরুর প্রজননতন্ত্র মূলত মিয়ানমারে রপ্তানি করা হয়। সেখানে এর স্যুপ খুবই বিখ্যাত খাবার।

হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচরের একেকটা কারখানা বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ টন হাড় সংগ্রহ করে কাঁচাবাজার ও ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে। এর বেশিরভাগই ওষুধ কোম্পানি অপসোনিনে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া কিছু অংশ মিয়ানমার, ভারত, জাপান, ইরানসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়।

সারা দেশে ৩৫টির মতো কারখানা রয়েছে, যেখানে হাড় গুঁড়ো করা হয়। রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়াও হাড় ভাঙার কারখানা আছে যাত্রাবাড়ী ও মৃধাবাড়ী এলাকায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে চারটি হাঁড়ের কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৩টি হাড় কারখানা প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার হাড় বিদেশে রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। ৩টি কারখানাই বর্তমানে লাভজনকভাবে চলছে। এগুলো গত অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার পশুর হাড় রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এখন হাড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।

পাড়া মহল্লা থেকে হাড় সংগ্রহকারী মজিবর বলেন, রাজধানীতে ঈদের সময় পশু কোরবানির পর হাড় সংগ্রহ করে টোকাইরা। তারা হাড় ভাঙ্গারীর দোকানে বিক্রি করে। পরে সেই উচ্ছিষ্ট যায় হাজারীবাগের হাড্ডি পট্টির আড়তে। প্রকার বেধে প্রতি টন হাড়ের মূল্য ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা টাকা।