শেখ হাসিনার ৭২তম জন্মদিন আজ

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৭২তম জন্মদিন আজ শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় গত দশ বছরের ন্যায় এবারের জন্মদিনেও তাকে কাছে পাচ্ছেন না দলের নেতাকর্মীরা। তবে, তার অনুপস্থিতিতে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো অন্যান্য বছরের মতো এবারও মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলীয় সভাপতির জন্মদিন উদযাপন করবে।

মধুমতি নদী বিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। আর এই নিভৃত পল্লীতেই ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ডাক নাম হাসু। পিতা বঙ্গবন্ধু আদর করে এই নামেই ডাকতেন তাকে। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দাদা-দাদির কোলে-পিঠে, বাইগার নদীর তীরে, টুঙ্গীপাড়ায়।

বাবার দেখা পেতেন খুবই কম। জেল-জুলুম, রাজরোষ ছিল পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিত্য সহচর। রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সংগঠন নিয়েই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দিন-রাত্রি ও যাপিত জীবন। এ কারণে ছেলে-মেয়েরা পিতার সান্নিধ্য পেয়েছেন খুবই কম। তারা পাঁচ ভাই-বোন। অপর চার জন হলেন— শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। শেখ হাসিনা গ্রামবাংলার ধুলোমাটি আর সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। গ্রামের সঙ্গে তাই তার নিবিড় সম্পর্ক।

তিনি প্রায়ই তার বক্তব্যে বলেন, জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি গ্রামেই কাটিয়ে দেবেন। তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে গ্রামের প্রতি তার টানের কথা।

শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন তারা পুরনো ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় ওঠেন। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করা হয়। তিনি ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬-দফার দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণের সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্তস্ত্র হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তার জীবন ও পরিবারের ওপর দিয়ে বয়ে যায় নিপীড়নের ঝড়। এই ঝড়ো দিনগুলিতেই, কারাবন্দি পিতা বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয় ১৯৬৮ সালে। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় ১১-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর তার গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দি অবস্থায় প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম দেন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যা সন্তান পুতুলের জন্ম হয়।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এ সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এ অবস্থায় দেশে ফিরতে না পেরে তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।

১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সরকারের আমলেই ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১.৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকাল তার দল আওয়ামী লীগ চিহ্নিত করে স্বর্ণযুগ হিসেবে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে জয়লাভ করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সফলতার সঙ্গে দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ করে বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে দেশবাসী সুফল পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারানির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বার বার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল। সহজ সারল্যে ভরা তার ব্যক্তি জীবন। মেধা-মনন, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য্য, দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। পোশাকে-আশাকে, জীবন-যাত্রায় কোথাও কোনও প্রকার বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার ছাপ নেই। নিষ্ঠাবান ধার্মিক তিনি। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে দিনের শুরু করেন। পবিত্র হজব্রত পালনের পাশাপাশি কয়েকবার করেছেন ওমরাহ হজ।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ইতোমধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ অসংখ্য পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে।
মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তার এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিখাঁদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে।
জন্মদিনের কর্মসূচি

শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনার বিষয়বস্তু ‘নবীনদের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা’। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে দেশের সব মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সকাল ১০টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের ৬৭ হাজার ৩৬৮টি গণশিক্ষা কেন্দ্র, ১০১০টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, ইসলামিক মিশনের ৪৪৯টি মক্তব ও ২৬টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং ৫৪১টি মসজিদ পাঠাগারসহ মোট ৬৯ হাজার ৩৯৪টি স্থানে সকাল ৯ টায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়েছে।

এছাড়াও বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সকাল ১০টায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (মেরুল বাড্ডা) ও সকাল ৯ টায় খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিএবি) ওয়াই.এম.সি. এ চ্যাপেল, ২৯ সেনপাড়া, পর্বতা, মিরপুর-১০ এবং সকাল ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেবেন।

একইদিন সকাল ১০টায় ঢাকাসহ সারাদেশে সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে আনন্দ র্যালি ও শোভাযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হবে। অনুরূপ কর্মসূচি জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়েও পালন করার কথা রয়েছে।