যশোর শহরতলীর উপশহরে অবস্থিত প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকু হত্যাকান্ডের প্রায় দেড় বছর পার হলেও খুনের সুনিদিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালি মহল ভিকু হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ আড়াল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পরিবারের।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সিআইডির পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুনর রশিদ বলেন, প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকু হত্যাকান্ডের সুনিদিষ্ট কারণ এখনো উদঘাটন করা যায়নি। তবে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, বেশ কয়েকটি সম্ভব্য কারণে ভিকুকে হত্যা করা হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ গুলি হচ্ছে এনজির লোন সংক্রান্ত বিরোধ, ভিকুর ব্যক্তিগত ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধ, স্থানীয় চাঁদাবাজি সংক্রান্ত বিরোধ ও স্ত্রী আমেনার সাথে পারিবারিক বিরোধ। এসব কারণে ভিকুকে হত্যা করা হতে পারে।
তদন্ত কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান, মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। প্রকৃত কারণ উদঘাটনে আরো সময় লাগতে পারে। এরই মধ্যে কি কারনে কারা প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকুকে হত্যা করেছে তার রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদি।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুনর রশিদ দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে তার তদন্ত কার্যক্রমে নিশ্চিত হয়েছেন যে ভড়াটে খুনি দ্বারা ভিকুকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই খুনের সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল জড়িত। তারা নিজেরা বাঁচার জন্য খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক কারণে এদেরকে কিছু করা যাচ্ছে না বলে সিআইডি কর্মকর্তা দাবি করেন।
এদিকে ভিকু হত্যাকান্ডের আগে ও পরে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল খুনিদের খুন করে বেরিয়ে যেতে সহোযোগিতা করেছে বলে ভিকুর পরিবার ও স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
২০১৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে উপশহর সি ব্লকের ৫৬ নং নিজ বাড়ির সামনে প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকুকে গুলি করে ও বোমা মেরে হত্যা করা হয়। একটি গুলি ভিকুর বাম চোখের নিচ দিয়ে ঢুকে মাথার পিছন থেকে বেরিয়ে যায়। ভিকু রাস্তার উপর পড়ে যায়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় ভিকুকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করেন। পরের দিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর রাত ৮ টা ৩৫ মিনিটের সময় থানায় উপস্থিত হয়ে ভিকুর স্ত্রী শারমিন আক্তার লাকি বাদি হয়ে মামলা করেন। মামলা নং-৮/১৬৪২। ধারা-৩০২/৩৪, পেনাল কোড-১৮৬০; তৎসহ ৩/৬, ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে হত্যা ও সহায়তা করা এবং বোমার বিষ্ফোরন ঘটানোর অপরাধ। তারিখ ০২.১২.১৭। মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখসহ আরো ৫/৭ জনকে আজ্ঞাত আসামি করা হয়। মামলার প্রধান তিন অভিযুক্ত আসামি হলেন সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে বাহার, একই উপজেলার ঘুরুলিয়া গ্রামের আবেদ আলি মোল্লার ছেলে মাসুদুর রহমান, ঝিনাইদহ জেলার মহেষপুর উপজেলার সস্তার বাজারের নস্তি কামার পাড়া গ্রামের আলা উদ্দিন বিশ্বাসের মেয়ে আমেনা খাতুন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে আসামি বাহার ও মাসুদ প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। আসামি আমেনা খাতুন আগে কর্মরত ছিলেন।
মামলাটি রুজু হওয়ার পর তদন্তের দায়িত্ব পান কোতয়ালি থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) আলমগীর হোসেন। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান অভিযুক্ত দুই আসামি মাসুদ ও আমেনাকে আটক করে। হত্যাকান্ডের ঘটনাটি জটিল হওয়ায় অধিক তদন্তের স্বার্থে এক মাস পর মামলাটি যশোর সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পান পরিদর্শক হারুনর রশিদ। এরপর সিআডির পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকতা হারুনর রশিদ প্রায় দেড় মাস পর এজাহার ভুক্ত আসামি ভিকুর এনজিওর ম্যানেজার বাহারকে আটক করে। বাহারকে আটকের ২/৩ মাস পর অজ্ঞাত আসামিদের মধ্যে পর্যায় ক্রমে ভাড়াটে খুনি হিসেবে পরিচিত যশোর সদর উপজেলার হাসিমপুর গ্রামের আমজাদ মোল্লার ছেলে জুয়েল (২৮) একই উপজেলার শ্যামনগর গ্রামের মৃত সায়েদ আলী বিশ্বাসের ছেলে কেরু নজরুল (৫০) ও শহরের শংকরপুরের কেনাই চৌধুরির ছেলে কবীর হোসেন (৩৫) কে আটক করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুনর রশিদ বলেন, অটককৃত অজ্ঞাত আসামিদের মধ্যে জুয়েল দুধর্ষ প্রকৃতির। এর আগেও জুয়েল টাকার বিনিময়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রমানের অভাবে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে পার পেয়ে গেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান, বাহারকে আটকের পর তাকে দুইবার রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করলে আদালত রিমান্ড দেয় না। পরে অজ্ঞাত আটক তিন আসামির রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হলে আদালত রিমান্ড মঞ্জুর না করে জেলগেটে জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়। বর্তমানে আসামিরা জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাদি শারমিন আক্তার লাকি ও নিহত ভিকুর স্বজনদের মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুমকি ধামকি দিচ্ছে।
সুত্র গুলি বলেছে, ভিকুর এনজিওতে দায়িত্ব প্রাপ্ত এরিয়া ম্যানেজার সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে বাহার এনজিও পরিচালক ভিকুকে না জানিয়ে স্থানীয় এক ইজিবাইক ব্যবসায়িকে ১৮ লাখ টাকা লোন দেন। ওই সময় ভিকু চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ভারতে অবস্থান করেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার পর হিসাবে গরমিল দেখা দিলে ১৮ লাখ টাকার গোপন লোনের বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ে।
অবশ্য সূত্র গুলি বলেছে, বাহার নিজেকে নিদোর্ষ প্রমান করতে ইজিবাইক ব্যবসায়ির সাথে তিনশ টাকার একটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ৬০ হাজার টাকার চুক্তি করে। বাকি টাকার কোন হিসাব বাহার দেখাতে পারে না। এবিষয়টি নিয়ে এরিয়া ম্যানেজার বাহারের সাথে ভিকুর বিরোধ চরমে পৌছায়। ম্যানেজার বাহার ভিকুকে দেখে নেবারও হুমকি দেয়। বাহারে পক্ষ নিয়ে ওই ইজি বাইক ব্যবসায়ি ভিকুকে তার প্রতিষ্ঠানে (মানসী সিনেমা হলের সামনে) ডেকে নিয়ে শারিরীক ভাবে লাঞ্ছিত করে। ঘটনাটি সম্পর্কে এনজিওতে কর্মরত অন্যকর্মীসহ এলাকাবাসি ও ভিকুর পরিবার জেনে যায়। এঘটনার সাথে মামলার দ্বিতীয় আসামি হিসাব রক্ষক মাসুদও জড়িত ছিল। কারণ এনজিওর টাকা পয়সার হিসাব মাসুদের কাছেই থাকতো।
সূত্র গুলি বলেছে, হিসাব রক্ষক মাসুদের সহযোগিতায় ম্যানেজার বাহার ১৮ লাখ টাকার ঘাপলা করে। আর এই টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তোলা লোনের টাকা। এই টাকা গুলো বাহার এনজিওতে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টি একমাত্র মাসুদ জানলেও টাকার লোভে গোপন করে। আর তিন নম্বর আসামি আমেনার সাথে ভিকুর পারিবারিক বিরোধ চলছিল।
সূত্র গুলি জানায়, আমেনা ঝিনাইদহের একটি আদালতে ভিকুর বিরুদ্ধে মামলাও করে। মামলায় সুবিধা করতে না পেরে ১ও ২ নম্বর আসামিদের সাথে হত্যার পরিকল্পনায় যোগ দেয়।
অপর দিকে ভিকুর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও মোটা অংকের টাকা উৎকোচ গ্রহনের কারণে যশোরের আলোচিত প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকু হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হচ্ছে না। ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে হত্যাকান্ডের মূল নায়করা।
ভিকুর স্ত্রী মামলার বাদি শারমিন আক্তার লাকি ভিকু হত্যার বিচার দাবি করে বলেছেন, তার স্বামীর প্রকৃত খুনিদের খুজে বের করে আইনে সোপর্দ পূর্বক দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া হোক। খুনিরা যাতে আর কোন মানুষকে খুন করে এভাবে তাদের সন্তান ও স্ত্রীদের অবিভাবকহীন করতে না পারে।
প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিহত ভিকুর ভগ্নিপতি মোর্শেদুল ইসলাম প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের কাছে দাবি জানিয়েছেন।