মণিরামপুরে সরকারি ধান ক্রয়ে নয়ছয় : কৃষকের ঠাঁই হচ্ছেনা, পকেট ভরছে ব্যবসায়ীরা!

jessore map

সরকার কৃষকদের আবাদকৃত ধানের ন্যায্য মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে এ বছর সরকারিভাবে ১০৪০ টাকা মণ বা ২৬ টাকা কেজি দরে ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। যদিও ধান উৎপাদিত পরিমানের চেয়ে লক্ষ্য মাত্রার অনেকগুন কম বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এই সামান্য বরাদ্দটুকু কৃষকের ভাগ্যে জুটছে না। সংশ্লিষ্ঠ ক্রয়কারী কর্মকর্তা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ধানের পরিবর্তে চাল কিনে কৃষকদের বঞ্চিত করছে।

যশোর মণিরামপুর উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।

এ বছর মণিরামপুরে ২৩০৪ মে/টন ধান বরাদ্দ হয়। যা কৃষক নামধারীদের নামে খরিদ দেখানো হচ্ছে। বাস্তবে তার নেপথ্যে ওসিএলএসডি স্থানীয় সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজস করে কাগজ কলমে ধান ক্রয় দেখিয়ে সরাসরি গুদামে চাল সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। স্থানীয় কৃষকেরা ধান বিক্রয়ের বিষয়টি না জানলেও ইতোমধ্যে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পূরণ হয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, মণিরামপুরে সরাসরিভাবে কৃষকের থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান কেনার নিয়ম মানা হচ্ছে না। এখানে নানাবিধ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ করে চাষীর কার্ড ব্যাবহার করে ভর্তুকীর টাকা ভাগাভাগি করে নেয়া হচ্ছে। সিন্ডকেট আর দলীয় নেতারা এই সুযোগ নিচ্ছেন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সয়ং গুদাম রক্ষক মনজুরুল আলম। ফলে যাদের জন্য সরকারের এই বিশাল ভর্তুকী, সেই প্রান্তিক চাষীরা সুফল থেকে পুরোটাই বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকেরা জানে না গুদামে সরকারিভাবে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। এজন্য কৃষকের আনাগোনা নেই। তারপরও মণিরামপুরে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অদৃশ্যভাবে পূরণ হতে চলেছে।

সূত্র বলছে, সময়মত সরকারি ধান সংগ্রহ এখানে শুরু না হওয়ায় এখানকার গরীব চাষীরা পাওনাদারদের হালখাতার চিঠি পেয়ে পানির দরে ধান বিক্রি করে দিয়েছে। তখন প্রতি মন ধান ৫০০ থেকে ৬০০ দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে।

তথ্যমতে জানা যায়, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষকদের তালিকা দিয়েছেন। তালিকায় নাম আছে এমন কৃষকের আবেদনপত্র কৃষি অফিসার হীরক সরকার সুপারিশসহ গুদামে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও গুদামে ধান দিতে গেলে কৃষকদের আবেদন করতে বলা হচ্ছে। তালিকা দেওয়া হলে আবার আবেদন করার কারন কি? তবে কি তিনিও লুটপাটের অংশিদার হতে চাইছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেল, তালিকা প্রণোয়নে কাজ করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক আর্শিবাদপুষ্ট সিন্ডিকেট প্রধান শহীদুল ইসলাম। তিনিই চাষী সাজিয়ে গুদামে আবেদন করাচ্ছেন। আর গুদামে আবেদনকারীর নামে ডব্লিউকিউএসসি ইস্যু করে ব্যাংকে নিয়ে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের সাজানো হচ্ছে ‘যে তারা গুদামে ধান বিক্রয় করেছে’। কৃষক নামধারীর কাছ থেকে ধান ক্রয় ছাড়াই ধান ছাড়াই ৩ টন ধান বিক্রয়ের কাগজ প্রস্তুত করে নগদে ৫০০ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক ঘন্টার জন্য ৫০০ টাকা ‘সাজানো চাষী’ এতেই সন্তুষ্ট। এভাবে টন প্রতি ১৩০০০ টাকা হিসেবে সরকারি ৩ কোটি টাকা ভর্তুকীর অর্থ যাচ্ছে সিন্ডিকেট এবং ওসিএলএসডির মনজুরুল আলমের পকেটে। ওসিএলএসডি মনজুরুল আলম ধান না কিনেই কাগজে কলমে ডেলিভারী দেখাচ্ছেন ৫ টি মিলের অনুকুলে। চুক্তিবদ্ধ ৫টি মিল ধান গুদাম থেকে না নিয়ে, না ভাঙিয়ে বাজার থেকে চাল কিনে যশোর সদর গুদামে সরবরাহ করছেন। এতে পরিবহন খরচও সাশ্রয় হচ্ছে। যদিও সরকারি পরবিহন বিল বাবদ তারা মোটা অংকের অর্থ নিয়েছেন। ধান ক্রয় না করেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশেষ কায়দায় চাল সংগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেন, ‘এ যেন শখের করাত আসতেও কাটে যেতেও কাটে’।

সর্বশেষ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রন দপ্তরের ২০/০৮/১৯ তারিখের ২৫২৭ নং বরাদ্দাদেশের অনুকুলে ৫ টি মিলে প্রায় ১৪০ মে/টন ধান মিলিং এর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। মিল গুলো হচ্ছে মেসার্স রুবেল সেমি অটো রাইস মিল, মেসার্স আল-আমীন রাইস মিল, মেসার্স বিসমিল্লাহ রাই মিল, মেসার্স ভাই ভাই রাইস মিল ও মেসার্স নবিছ উদ্দিন রাইস মিল। শুধুমাত্র কাগজে কলমে এই মিলে ধান সরবরাহ করা হয়েছে। কোন মিলার এখন পর্যন্ত কোন মিলার গুদাম থেকে ধান ডেলিভারী নেয়নি কিংবা দেওয়া হয়নি।

সূত্রে জানা গেছে, এবার ফলিত চাল দিতে হবে যশোর সদর গুদামে। এখানেও সিন্ডিকেট বাজার থেকে পুরাতন ধানের চাল ২৫ টাকা কেজি দরে কিনে সরবরাহ করছে। অর্থ্যাৎ ধানের চেয়ে কম দামে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। ধানের বিল নিয়েছে ২৬ কেজি দরে আর ফলিত চাল সরবরাহ করছে ২৫ টাকা কেজি দরে। উভয়মূখি ব্যবসা। সরকারি ভর্তুকী লুটপাটের মহোৎসব। হাস্কিং মিলে ধান বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। আর জমা হচ্ছে অটো মিলের বিগত মৌসুমের ধানের থেকে প্রস্তুকৃত চাল। যে মিল গুলিতে ধান বরাদ্দ এবং মিলিং এর জন্য ডেলিভারী দেখানো হয়েছে সে মিলে অদৌ কোন ধান ক্রাশিং হয়েছে এমন তথ্য মেলেনি। বিরুপ আবহাওয়ায় এবং এসব মিলের বিদুৎ বিল পরীক্ষা করা হলে যার সত্যতা মিলবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে সরবরাহকৃত চালের নমুনা পরীক্ষা করা হলে মনিরামপুর ধান সংগ্রহের রহস্য উন্মোচিত হবে।

লুটপাটের এখানে শেষ নয়, ধান না কিনে শ্রমিক ঠিকাদারকে বিল দিতে হচ্ছে, মিলে পরিবহন বাবদ বিল, আবার চাল ক্রাশিং না করে ক্রাশিং বিল, ফলিত চাল পরিবহন বাবদ বিল। এখানেও শ্রম ও হস্তার্পণ বিল সরকারকে দিতে হচ্ছে। সরকারী ভর্তুকীর টাকা যথেচ্ছার লুটপাটে দেখার কেউ নেই। সবাই যেন একসূত্রে গাঁথা।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, স্বচ্চতার সাথে ধান ক্রয় করা হলে বাজারে তার প্রতিফলন পরিলক্ষিত লক্ষ্য করা যেত। রাজনৈতিক ব্যবসায়ী এবং ওসিএলএসডিদের লাগাম ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় লক্ষ লক্ষ টন ধান সংগ্রহ করা সত্বেও বাজার দরে তার কোন প্রভাব পড়ছে না। জনগনের অর্থ সরকারী ভর্তুকী যাদের জন্য তারা কোন সুফলই পাচ্ছেনা। পকেট ভরছে দুর্নীতিবাজদের।

অভিযোগের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মণিরামপুরের ওসিএলএসডি মনজুরুল আলম ধানের পরিবর্তে চাল কেনার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব?

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মণিরামপুর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মামুন রহমান বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। সঠিক হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।