অস্থির তেলের বাজার

ইরাকে মার্কিন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ব্যারেল প্রতি সর্বনিম্ন ৩ ডলার থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৭০ ডলার বাড়ে মূল্য। গতবছর সৌদি আরবের প্রধান তেল স্থাপনায় হামলার পর এটাই তেলের বাজারে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। মার্কিন হামলার তীব্র প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান। এতে অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে দুইদেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। তেমনটা হলে তেলের বাজারে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধস নামতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কেবল তেলের বাজার নয়, অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বিশ্বের প্রায় সকল শেয়ার বাজারগুলোয়।

ইউরোপ-ভিত্তিক শেয়ার বাজার বিষয়ক সূচক প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান শুক্রবার স্টক্স ৬০০ জানিয়েছে, তাদের সূচকে বাজারমূল্য এক শতাংশ কমেছে। এতে লোকসান হয়েছে অবশ্য ০.৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ওয়াল স্ট্রিট শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে ০.৮ শতাংশ।

সোলাইমানির হত্যার প্রতিশোধের দাবিতে বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। এতে উদ্বেগে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে তেলের বাজারে বড় প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হরমুজ প্রণালী।

হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়। ২১ কিলোমিটার প্রস্থের এই প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইরানের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিশোধে এই প্রণালীতে অবরোধ জারি করলে বা বিদেশি জাহাজ যাতায়াত বন্ধ করে দিলে তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বাজারে। কিন্তু এখান দিয়ে জাহাজ যাতায়াত করতে দেয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। আইনটিতে ইরানের স্বাক্ষরও রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, হরমুজ প্রণালী দিয়ে ইরান যেকোনো জাহাজকে যাতায়াতের অনুমতি দিতে বাধ্য। কিন্তু দেশটির পার্লামেন্ট আইনটির প্রতি সমর্থন জানায়নি। ফলে ইরান সরকার সেটা মানবে কি-না তা সন্দিহান।

এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ হলেও তেলের দামে বড় মাপের পরিবর্তন নাও আসতে পারে। ব্যাংক অব আমেরিকার এক পণ্য বিষয়ক কৌশলী জানান, ২০০৪ সাল আর বর্তমান সময়ের মধ্যে বহু ভিন্নতা রয়েছে। পরিবর্তন এসেছে তেলের বাজারে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মধ্যপ্রাচ্যের ওপর তেলের জন্য সমপূর্ণ নির্ভরশীল নয়।

তেলের বাজারে অস্থিরতা গত বছরও দেখা গেছে। হরমুজ প্রণালীতে সৌদি ট্যাংকারে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বেড়েছিল তেলের দাম। সে সময় সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল তেলের দাম। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্থিতিশীল হয়ে যায়। পরবর্তীতে সৌদি আরবের প্রধান তেল স্থাপনাতেও হামলা হয়। এরপরও সাময়িকভাবে বাড়ে তেলের দাম। কিন্তু কখনোই উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রভাব পড়েনি।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল বাণিজ্যের প্রধান কার্টেল হচ্ছে ওপেক। ইরাক যুদ্ধের সময় সংস্থাটির তেলের বাজারে যে প্রভাব ছিল তা এখন অনেকটাই কমেছে। ব্যাংক অব আমেরিকার পণ্য বিষয়ক কৌশলী মাইকেল উইডমের বলেন, ওপেক যখনই তাদের উৎপাদন কমায় তখনই নতুন কোনো দেশ তেলের বাজারে তাদের জায়গা করে নেয়।

উড ম্যাকেনজির মার্কেটিং ও গবেষণা দলের প্রধান এলান গেল্ডার বলেন, একসময় ওপেক বিশ্বের অর্ধেক তেল উৎপাদন করতো। এখন সংস্থাটি এটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশেরও কম তেল উৎপাদন করে।

১৯৯০ সালের গাল্ফ যুদ্ধের সময় পশ্চিমা দেশগুলো দুই জায়গা থেকে তেল পেতো- ওপেক ও উত্তর সাগর। কিন্তু উত্তর সাগর থেকে তেল উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খুবই ব্যয়বহুল ছিল। বিশেষ করে বছর চল্লিশ আগে সেটি বেশ অননুমেয় ও কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু এখন উত্তর আমেরিকা থেকেই তেল উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে। গেল্ডার বলেন, তৎকালীন সময়ে তেলের বাজার সবে স্থাপিত হচ্ছিল। বর্তমান বাজারে প্রতিযোগীর সংখ্যা বহু। এছাড়া, পাঁচ বছর আগের চেয়ে বর্তমানে তথ্য পাওয়া আরো সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।