মুসল্লিদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক

মসজিদে নামাজের জামায়াতে এখন রমজানের মত ভিড় কোথাও কোথাও। কোনো কথাই শুনছেন না কেউ। মুসল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতিতে ভয় পাচ্ছে সরকারও। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কড়া সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। যেহেতু রোববারের (২৯ মার্চ) বৈঠকে কঠোর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একমত হওয়া যায়নি। যে কারণে ইফার ওয়েবসাইটের নোটিস বোর্ডে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশবাসীর কাছে এগুলো পরিপালন করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে ‘মসজিদে নিয়মিত আযান, ইকামত, জামাত ও জুমার নামাজ অব্যাহত থাকবে। তবে জুমা ও জামাতে মুসল্লিগণের অংশগ্রহণ সীমিত থাকবে।’ যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের বেশকিছু ক্রাইটেরিয়া দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জুমার দিনে সুন্নাত ও নফল নামাজ আদায় করতে হবে যার যার নিজের বাড়ি বা বাসায়।

করোনা ইস্যুতে সারা বিশ্বে ইসলামি স্কলাররা দ্বিধাবিভক্ত মতামত দিচ্ছেন। একসাথে কেউ একটি জায়গায় পৌঁছাতে পারছেন না। যদিও অবস্থা কিছুটা পাল্টেছে। আস্তে আস্তে সবাই সমঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তার ফলে আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি এটা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা। ইতোমধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত যে খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া গেছে; তাতে দুনিয়াব্যাপী করোনায় মৃতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এবং আক্রান্ত কয়েক লাখ।

তবে আসল কথা হলো, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের সামনে একটা কঠিন বিপদবার্তা। ইতোমধ্যে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পিকটাইম হতে পারে আগামী দুই সপ্তাহ। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? নানাজন নানামত দিচ্ছেন। আমরা ধর্মীয় ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের শুভবুদ্ধি উদয়ের জন্য কিছু নিবেদন করতে চাই। ইতোমধ্যে আমরা পাকিস্তান ও ভারতের দুটি ঘটনা আমলে নিয়েছি। প্রথমটি হচ্ছে পাকিস্তানের। আপনাদের জানা থাকতে পারে পাকিস্তানে একই ধারার মাদরাসা ব্যবস্থা। আর সেটা হচ্ছে কওমি মাদরাসা। সেখানে আলেমদের খুবই সম্মানীয় ব্যক্তি হচ্ছেন মাওলানা ফজলুর রহমান। তাকে নিয়ে একটি রিপোর্ট ছেপেছে ঢাকার একটি শীর্ষ দৈনিক। বলা হয়েছে, তিনি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ ও রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। মাওলানা ফজলুর রহমান পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান । তাকে বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবেই চেনেন। অনেক মফস্বল শহরেও তিনি এসেছেন একাধিকবার। এদেশে তিনি আসতেন ওয়াজ করতে। উর্দুতে দেওয়া বয়ান দোভাষী বুঝিয়ে দিতেন। খুব জনপ্রিয় তিনি। এদেশের আলেমরা তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন ও ভালোবাসেন।

মাওলানা ফজলুর রহমান পাকিস্তানে করোনায় প্রথম আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই সব কার্যক্রম ও পদচারণা নিজ বাসভবনে সীমিত করে রেখেছেন। এমনকি জুমার নামাজও বাসার কম্পাউন্ডে অবস্থিত মসজিদে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আদায় করছেন।

তিনি পাকিস্তানের একটি শীর্ষ দৈনিকে আহ্বান জানিয়েছেন, ধর্মীয় সব মতাদর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেমরা এই সংকটে যেন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন যে, শুধু মুয়াজ্জিন, ইমাম ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা জামাতের সঙ্গে মসজিদে নামাজ আদায় করবেন।

তিনি বলেন, যদি মসজিদে নামাজের জন্য জমায়েতের ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে তাহলে জনগণের করণীয় হলো, তারা মসজিদে যাবে না এবং ঘরেই নামাজ আদায় করবে।

করোনাভাইরাস এ মুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটাকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে। এই বৈশ্বিক মহামারী বিশ্বমানবতাকে আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য করেছে। আমাদের ধর্ম এ ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিছু সহজ বিকল্প পদ্ধতি দিয়েছে।

জেইউআই (এফ) প্রধান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ নিজ নিজ ঘরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জামায়াত সহকারে নামাজ আদায় করতে পারেন।

এদিকে ভারতে বলা হচ্ছে, তাবলিগের গোয়ার্তুমির জন্য ইতিমধ্যে সাতজনের করোনায় মৃত্যু হয়েছে। সে কারণে বাধ্য হয়ে দিল্লির সরকার তাবলিগের মারকাজ নিজামুদ্দিন বন্ধ করে দিয়েছে। সংবাদ অনুযায়ী, ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় একটি মসজিদে তবলিগের জমায়েতের পর ২৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে সাতে পৌঁছেছে। ১৩ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত দিল্লিতে দেশটির তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিজামুদ্দিনে প্রায় দুই হাজার মানুষ একসঙ্গে অবস্থান করেন। এরপর এ ঘটনা ঘটে। এ কারণে সেখানকার সরকার করোনার উপসর্গ রয়েছে আশঙ্কায় গত সোমবার তিন শতাধিক মানুষকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মারকাজ নিজামুদ্দিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে থাকা ৭০০ জনকে বাসে করে নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।

এই যখন আমাদের পাশের দেশের অবস্থা, তখন দুর্ভাবনা তো আমাদের ঘাড়ে সবসময় নিশ্বাস ফেলছে। সামনে ১৪ দিন আসলেই খুবই কঠিন সময়। এখন ধর্মীয় নেতাদের তাই কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষাটাকে মুসল্লিদের সামনে পেশ করতে হবে। খুবই আশার কথা হলো, সবাই যখন ঐতিহাসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পিছপা; তখন মধ্যপ্রাচ্যে বিখ্যাত ইসলামি স্কলার কলম ধরেছেন। তার নাম ড. আলী সাল্লাবি। লিবিয়ার বিশিষ্ট আলেম। থাকেন সৌদি আরবে। তার নিবন্ধটি ছাপা হয়েছে আল-জাজিরার আরবি ভার্সনে। এটা পড়ে দেখতে পারেন আমাদের আলেমরা। কারণ তিনি উপযুক্ত রেফারেন্সও হাজির করেছেন।
উমর ইবন আল খাত্তাব (রা.)-এর জীবনীতে মহামারী বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে এমন কিছু নির্দেশনা রয়েছে যা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। ১৮ হিজরিতে একটি ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে, যা ইতিহাসে ‘আমাওয়াস প্লেগ’ হিসাবে পরিচিত। আমাওয়াস হলো জেরুজালেম এবং রামাল্লার মধ্যবর্তী একটি এলাকা। এখান থেকেই রোগটির উৎপত্তি হয়েছিল। পরে তা শাম তথা বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে একে ‘আমাওয়াসের প্লেগ’ বলা হয়। আমার জানা মতে, এ রোগটি সম্পর্কে যিনি সবচেয়ে ভালো লিখেছেন, তিনি হলেন ইবনে হাজার আসকালানি। তিনি আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘প্লেগ হলো, বিশেষ কোনো অঙ্গে রক্তের অতিরিক্ত চাপ বা প্রবাহের কারণে অঙ্গটি ফুলে গিয়ে তাতে বৈকল্য দেখা দেওয়া। এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে ছড়িয়ে যাওয়া ব্যাপক রোগ-ব্যাধিকেও প্লেগ বলা হয়। তবে তা রূপক অর্থে। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে কিংবা মৃত্যুর ব্যাপকতা ঘটে।’

মহামারি এবং প্লেগের মধ্যে এই পার্থক্যের উদ্দেশ্য হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হাদিসের সত্যতা প্রমাণ করা। কেননা হাদিসে আছে, প্লেগ মদিনা শরিফে প্রবেশ করবে না, তবে মহামারী প্রবেশ করতে পারে। বিগত শতাব্দীতে মহামারী মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় মুসলমান ও রোমানদের মধ্যে বিশাল যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক মরদেহ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বায়ু দূষিত হয়ে মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তা ঘটেছিল।

শামে আমাওয়াস প্লেগ-এর বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসে একটা ভয়ংকর মহামারি। এতে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। শামের গভর্নর আবু উবায়দাতুবনুল জাররাহ, মুয়াজ ইবনে জাবাল, ইয়াযিদ ইবনে আবি সুফিয়ান, হারিস ইবনে হিশাম, (কারো মতে তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন) সুহাইল ইবনে আমর, উতবা ইবনে সুহাইল এবং নেতৃস্থানীয় অনেকেই। আমর ইবনুল আস-কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে এ মহামারীটি দূর হয়ে যায়। তিনি গভর্নর হওয়ার পর একটি ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘হে লোকসকল! এ মহামারি যখন কোথাও আপতিত হয় তখন তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অতএব তোমরা এ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়ে চলে যাও।’ এরপর তিনি পাহাড়ে চলে গেলেন। তার সাথে লোকজনও পাহাড়ে গেল। পাহাড়ে গিয়ে তারা আলাদা আলাদা হয়ে অবস্থান করলেন। অবশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামিন এ মহামারী উঠিয়ে নিলেন। মহামারীতে আমর ইবনুল আস যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তা ওমর (রা.) এর কাছে পৌঁছালে তিনি তা অপছন্দ করেননি।

সাল্লাবির নিবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ। এটা আলেম সমাজের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস থেকে। সাল্লাবির তথ্যমতে, আমাওয়াসেরে ওই মহামারী ছিল মুসলমানদের জন্য একটি বিরাট বিপদ। তাদের মধ্যে ২০ হাজারেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। এরা ছিল শামের জনসংখ্যার অর্ধেক। এই মুহূর্তে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথাটি মনে রাখতে হবে, “তোমরা যদি শোনো যে কোনো এলাকায় মহামারীর প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তাহলে সেখানে যাবে না। আর যদি তোমরা মহামারীকবলিত এলাকায় থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না।”

এ অবস্থায় আমরা মনে করি, আমাদের বিবেচনাবোধকে ধর্মীয় উন্মাদনায় না রেখে বুদ্ধিমান হওয়া দরকার। কোনোভাবেই গোয়ার্তুমিকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। গ্রামের মসজিদের ইমাম, আর শহরের ধার্মিক ইমামদের কাছে নিবেদন, আসুন সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিই। তা নাহলে বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে দেশ ও জাতির।
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও গবেষক
ঋণ : লিবিয়ার বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. আলী সাল্লাবি; লিংক : https://bit.ly/3dQweJp