নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতেই ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতির মাঠ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক ঘোষণায় আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক চলছে রাজনৈতিক অঙ্গন।
বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেখানে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছিল, সেই দাবিকে একপ্রকার উড়িয়ে দিয়ে ২০২৬ সালের এপ্রিলে ভোট আয়োজনের ঘোষণা অনেকের কাছেই এসেছে ‘অপ্রত্যাশিত ধাক্কা’ হিসেবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ— জাতীয় ঐকমত্য গঠনের পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টা একতরফাভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন না, বরং নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নিজের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এটি কি সত্যিই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, নাকি আরেকটি একতরফা ইভেন্ট?’
অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের মনেও তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া— একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে কৌতূহল। তারা প্রশ্ন তুলছে, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল—মোটে তো তিন মাসের ব্যবধান। তাহলে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো কেন এ ঘোষণাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না? কেনই বা তাদের এত জোর, নির্বাচন ডিসেম্বরেই হওয়া দরকার?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই তিন মাস শুধু সময়ের ব্যবধান নয়। এর পেছনে আছে গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, এবং সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের শঙ্কা—এই সময়টা ব্যবহার করে হয়তো কিছু ‘পেছনের খেলা’ হতে পারে। আবারও একটি ‘স্ক্রিপ্টেড নির্বাচন’ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সময়সূচি ঘোষণার পরপরই বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। দলটির দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল সব রাজনৈতিক দলকে এক টেবিলে বসিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সময় নির্ধারণ করা। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। বিএনপির অভিযোগ, প্রধান উপদেষ্টা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেখানে দেশের বড় একটি অংশের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। এতে করে তার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। দলটি আরও বলছে, এমন সিদ্ধান্ত জনগণের মনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে।
এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার বিরোধিতা করে বিএনপি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরেছে।
প্রথমত, তারা বলছে, এপ্রিল মাস আবহাওয়ার দিক থেকে অত্যন্ত প্রতিকূল। এ সময় দেশজুড়ে প্রচণ্ড গরম পড়ে, সঙ্গে যোগ হয় কালবৈশাখীর ঝড়। এমন আবহাওয়ায় ভোটারদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়া কষ্টকর হবে, আর নির্বাচনী কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
দ্বিতীয়ত, এই সময়টিই দেশের পাবলিক পরীক্ষার মৌসুম। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরুতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা চলতে থাকে। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে এই পরীক্ষার সময় নির্বাচন হলে তা শুধু শিক্ষার জন্য নয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাও জটিল করে তুলতে পারে।
তৃতীয়ত, রমজান ও ঈদকে ঘিরে এপ্রিলজুড়ে প্রচারণার সময় সংকুচিত হয়ে যাবে। দলটির দাবি, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানো কার্যত অসম্ভব।
চতুর্থত, এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের কারণে বাজেট প্রস্তুতিতে সময় সংকট দেখা দিতে পারে। এতে করে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিএনপির মতে, এসব বাস্তব কারণে এপ্রিলে নয়, নির্বাচন হওয়া উচিত ডিসেম্বরের মধ্যেই।
তবে বিএনপির আপত্তির পেছনে আরও একটি গভীর সংশয় কাজ করছে। এপ্রিলেই আদৌ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়েই তাদের ভরসা নেই। দলটির মতে, এপ্রিলে ভোটের ঘোষণা আসলে একটি কৌশল, যার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আরও বাড়ানোর পথ তৈরি করতে চাইছে।
এই সন্দেহের জায়গা থেকেই বিএনপি আশঙ্কা করছে, এপ্রিলের কাছাকাছি গিয়ে কোনো নতুন অজুহাত তুলে নির্বাচন আরও একবার পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘আমাদের দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন নয়, সে ব্যাপারে কোনো কথা কিংবা ব্যাখ্যা দেয় না সরকার। কি কি কারণে ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে না, তাও স্পষ্ট করতে পারেনি। এছাড়া ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর যে নির্বাচন হয়েছিল তা তিন মাসের মধ্যেই হয়েছিল। সে সময় যতটুকু সংস্কার করার তা করা হয়েছিল। কিন্তু এ সরকার প্রায় ১০ মাস আছে। এতদিনে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য কিছু তাদের নেই। ’
আগামী মাসে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এ লক্ষ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে একাধিক দফায় সংলাপে বসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। তবে এখনো অনেক বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব এখনো স্পষ্ট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিএনপি এই সনদে স্বাক্ষর না করে, তাহলে পুরো প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। সরকার পক্ষ তখন সহজেই পাল্টা যুক্তি দিতে পারে যে ‘বিএনপি আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায় না, তারা গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ গ্রহণ করছে না’।
এই অবস্থান সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছে, যেখানে সরকার নিজেকে আলোচনার পক্ষে, আর বিএনপিকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে পারবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের সময়সীমা কৌশলগতভাবে এমন এক সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, যেটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির জন্যও সংবেদনশীল। ২০২৬ সালের এপ্রিলেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন ঠিক তার আগে-পরে হলে এর রাজনৈতিক অভিঘাত পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে সেখানে বাংলাদেশবিরোধী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটেছে আগেও। এই সুযোগে বিজেপি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ইন্ধন দিতে পারে, যা নির্বাচনী পরিবেশকে নষ্ট করে দেওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করছে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক কূটনীতির সূক্ষ্ম ছায়া নিয়েও বিশ্লেষকরা কথা বলছেন। প্রকাশ্যে ভারত হয়তো একটি নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই অবস্থান নেবে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা চায় না বাংলাদেশে এমন একটি সরকার আসুক, যার গণভিত্তি দৃঢ়, অবস্থান স্বাধীন এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যে ভারতের একক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন তাই শুধু দেশের ভেতরের সমীকরণ নয়, হয়ে উঠছে আঞ্চলিক রাজনীতিরও একটি স্পর্শকাতর ইস্যু।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চীনের মদদপুষ্ট আরাকান আর্মি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে, তাতে করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে নতুন করে নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থার ফলে রোহিঙ্গা সংকট আবারও জটিল আকার নিতে পারে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের কাঁধে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা—তার ওপর যদি রাখাইনে সংঘাত বেড়ে যায়, তাহলে নতুন করে শরণার্থীদের ঢল নামার আশঙ্কা তৈরি হবে। এই চাপ শুধু মানবিক বা সীমান্ত-নিরাপত্তার নয়, জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়াতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একদিকে সীমান্তে অস্থিরতা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন— এমন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, এপ্রিলে নির্বাচনের প্রস্তাব আসলে একটি কৌশল, যার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন না করেই ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দিকে যেতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কিছু দাবি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা ধাপে ধাপে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনারও আশঙ্কা করছে দলটি।
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি পরিচ্ছন্ন, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করার আশা প্রকাশ করেন। এপ্রিলে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের বিষয়ে প্রধান যুক্তি হিসেবে তিনি সংস্কার ও বিচার কাজকে তুলে ধরছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এপ্রিলে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন আছে। বরং ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে সেটাই দেশের জন্য ভালো হতো। ’
এপ্রিলে নির্বাচনের সময় ঘোষণা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কোনো সুস্পষ্ট কারণ ব্যাখ্যা না করলেও রোববার (৮ জুন) রাতে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। নির্বাচনের সময় পেছানোর কারণ হিসেবে তিনি তিনটি যুক্তি দিয়েছে। ১. সংস্কার, ২. বিচার ও ৩. নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি।
শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচন আয়োজনের আগে কিছু মৌলিক সংস্কার দরকার, সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১২ থেকে ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ একে একে হাতে আসছে এবং সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও সর্বস্তরের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। এই বিবেচনায় এপ্রিলের প্রথমার্ধকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য উপযুক্ত সময় ধরে এগোনো হচ্ছে।
বিএনপির দাবি ও যুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, এপ্রিলের প্রথম দশ দিনে সাধারণত বড় ধরনের তাপপ্রবাহ থাকে না। এছাড়া কালবৈশাখীর সম্ভাবনাও বাড়ে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে, বৈশাখ শুরু হওয়ার পর। তাই আবহাওয়ার দিক থেকেও নির্বাচন আয়োজনের জন্য এপ্রিলের শুরুটা উপযোগী সময়।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান প্রায় অভিন্ন। কেননা, যেখানে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করছিল, সেখানে জামায়াত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হলে তাদের আপত্তি নেই বলে জানায়। অন্যদিকে এনসিপি সংস্কার ও শেখ হাসিনার বিচার শেষে ফাঁসির রায় কার্যকর করে হাসিনা উৎখাত আন্দোলনের আলোকে জুলাই সনদ ঘোষণার দাবিতে অনড় অবস্থানে। সরকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলটির প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে সরকার। ফলে নির্বাচন সময়সীমা ঘোষণাকে অনেকেই জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে সরকারের আতাত বলে মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে ৩০টি দল অংশ নিয়েছিল। এরমধ্যে ২৬টি দল কথা বলেছিল। যাদের মধ্যে ২৩টি দলই ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এরপর প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরে গিয়ে যে কথাটি বলেছেন, ‘শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কেউ ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না’, সেটা সঠিক না। সেখান থেকে অনুমান করা হচ্ছিল যে আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। নির্বাচন ডিসেম্বরে না হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি বা কখন দেওয়া যায়। একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই এপ্রিলে নির্বাচনের কথা বলেছে, এনসিপিও কিন্তু বলেনি। সে হিসেবে ধরতে পারি, সরকার জামায়াতে ইসলামীর কথা মেনে নিয়েছে বা নির্বাচনের সময়সীমা তাদের পক্ষে গিয়েছে। ’
কেন নির্বাচন ডিসেম্বরে না হয়ে এপ্রিলে হবে, সে বিষয়ে সরকারের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। ‘কেন ডিসেম্বর না, কেন তাদের পূর্ব নির্ধারিত শেষ সময় জুনেও না হয়ে এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা এলো, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া উচিৎ ছিল। সেটা না দেওয়ায় সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যে দলগুলো ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি করেছিল, তারা যদি এখন নির্বাচনে না যেতে চায়, তাহলে একটা বিরাট সংকট সৃষ্টি হবে। আমরা ইতোমধ্যেই জটিল সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। যদিও তারা এখনো সরাসরি নির্বাচনে না যাওয়ার মতো ঘোষণা দেয়নি। বরং সরকার ঘনিষ্ঠ দলগুলোই শর্ত আরোপ করেছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়িত না হলে তারা নির্বাচনে যাবে কি না, তারা প্রশ্ন রেখেছে। ’
তবে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এই সাক্ষাতের পর হয়তো এসব আলোচনা বা উত্তেজনা নতুন কোনোদিকে মোড় নিতে পারে। এটা আমরা আগে থেকেই কিছু বলতে পারি না। তবে এপ্রিলে যদি নির্বাচন হয়ও এবং তাতে যদি নিবন্ধিত সবগুলো দল অংশ না নেয়, তবে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শাসনামলের মতোই প্রহসনের নির্বাচন বলে বিবেচিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যেতে পারে। ’
নির্বাচন পিছিয়ে এপ্রিলে নির্ধারণ করার পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না জানিয়ে সাইফুল আলম চৌধুরী আরও বলেন, ‘এ দেশের নির্বাচনে পশ্চিমাদেশগুলোর আগ্রহ সবসময় পরিলক্ষিত। অতীতেও ছিল। আবার নির্বাচন করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে আমাদের ফান্ডিংও লাগে। নতুন করে করিডোর আর চট্টগ্রাম বন্দরের ইস্যুগুলোও এসেছে। পশ্চিমা দেশকে তো আমরা গুরুত্বও দিই। এই গুরুত্ব দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা প্রশ্ন থেকে যায়। ’
জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘিরে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা সামনে আরও ঘনীভূত হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। এপ্রিলে ভোট আয়োজনের ঘোষণায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিভক্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট শুধু সময়ের নয়, এটি বিশ্বাস ও বৈধতার সংকটও বটে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং স্বচ্ছ ব্যাখ্যা ছাড়া এই জট খুলবে না। আর যদি তা না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু জটিলই নয়, আরও অনিশ্চিত ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।