আসল এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক ছাড়া শেষ রক্ষা হবে না

করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) ভেতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস্ক। এরপরে গ্লাভস ও মাস্ক। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্কের নামে যা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো মানহীন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকদের যদি আসল এন-৯৫ মাস্ক না দেওয়া যায় তাহলে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) বা হাইডিপেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) দিয়েও শেষ রক্ষা যাবে না। ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক মাস্ক রাখলেও এন-৯৫ বা তার সমমানের মাস্কে যে কাপড় ব্যবহার করা হয় তা অনেক ধরনের ভাইরাস থেকে রক্ষা করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এন-৯৫ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হওয়া বিশেষ ধরনের মাস্ক। এ মাস্ক ঠিকমতো পরলে ৯৫ শতাংশ ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায়। আবার একই ধরনের মাস্ক যেটা চীনে তৈরি হয় তাকে বলা হয় কেএন-৯৫। ইউরোপে যেটা তৈরি হয় তাকে বলা হয় এফপিটু।

চিকিৎসকরা বলছেন, এন-৯৫ বলে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে সেগুলো, খালি চোখে দেখলেই বোঝা যায় এগুলো ‘ভুয়া’। এই প্রতিবেদককে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের দেওয়া মাস্কের ছবি দিয়েছেন। তারা বলছেন, এসব মাস্কের মান অত্যন্ত নিম্ন।

শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটের অনারারি মেডিসিন অফিসার ডা. ফয়সাল ইসলাম ফাহিম বলেছেন, ‘মাস্ক হিসেবে তাদের এন-৯৫-এর বদলে পাতলা গেঞ্জির কাপড়ে সেলাই করা জোড়াতালির মাস্ক দেওয়া হয়েছে। যা দিয়ে ধুলা কিছু আটকালেও কখনোই কোনও ভাইরাস আটকাবে না।’

এখন পর্যন্ত দেশের ১৭০ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফোরাম (বিডিএফ)। এরপরই পিপিই’র মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত এন-৯৫ বা কেএন-৯৫ তো দূরের কথা, সাধারণ মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল মাস্ক কোনোটাই কোনও হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়নি। প্যাকেটের ওপরে এন-৯৫ বা কেএন-৯৫ লেখা থাকলেও ভেতরে সাধারণ কাপড়ের মাস্ক বা তিন স্তরের সার্জিক্যাল মাস্কের নামে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের কাপড়ের এক স্তরের মাস্ক।

বিডিএফের প্রধান সমন্বয়ক ও মুখপাত্র ডা. নিরুপম দাশ বলেন, ‘কোয়ালিটিফুল পিপিই ও মাস্ক না দেওয়ায় একের পর এক চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন। এভাবে যদি চিকিৎসকরা আক্রান্ত হতে থাকেন তাহলে সেবা দেওয়ার জন্য কয়েকদিন পর চিকিৎসক পাওয়া যাবে না।’

পুরান ঢাকার মহানগর হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘একটা ভালো ফেসশিল্ড ও মাস্ক ভাইরাস থেকে প্রটেকশন দিতে পারে। কিন্তু এখন সার্জিক্যাল মাস্ক হিসেবে যেটা দেওয়া হচ্ছে তার কোয়ালিটি খুব খারাপ। উন্নত মানের মশারির কাপড় দিয়ে সেগুলো বানানো। এসব মাস্ককে সার্জিক্যাল মাস্ক বলে দেওয়া হচ্ছে।’

মানহীন মাস্ক দিয়ে কিছুই রক্ষা হবে না জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘আসল এন-৯৫ মাস্ক না থাকলে আইসিইউ, সিসিইউ বা এইচডিইউ চলবে না।’

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ট ফেইলিউর বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বলেন, ‘এন-৯৫ বা তার সমমানের মাস্ক চিকিৎসক থেকে রোগী বা রোগী থেকে চিকিৎসক যেন সংক্রমিত না হতে পারে সে প্রটেকশন দেয়। আবার এন-৯৫ বা তার সমমানের মাস্ক ভাইরাসকে বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না এবং ভেতর থেকে বাইরে যেতে দেয় না। যার কারণে রোগী এবং চিকিৎসকরা খুব প্রটেকটেড থাকেন। আবার আইসিইউ, সিসিইউতে বা অপারেশন করার সময় অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট যখন কাজ করেন তখন এটা দরকার। যেহেতু করোনাভাইরাস হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। তখন আইসিইউ, সিসিইউতে এর প্রয়োজনটাও ভীষণ। তাই এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক না হলে আইসিইউ, সিসিইউ, অ্যানেস্থেসিয়া অর্থাৎ সংকটাপন্ন জায়গাতে চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসক এবং রোগী উভয়পক্ষের জন্যই শঙ্কাজনক।’

এন-৯৫ মাস্ক প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘আইসিইউ, সিসিইউ, ওটি, ওয়ার্ড, কেবিনে যেখানে রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে চিকিৎসককে আসতে হবে সেখানে অবশ্যই এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক পরে থাকতে হবে। নয়তো চিকিৎসক প্রটেকশন পাবেন না। আর এটা না থাকলে চিকিৎসকসহ অন্যরা সংক্রমিত হবেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি, সরকার থেকে এটা সাপ্লাই হবে আজ ( ২১ এপ্রিল) থেকে। তার মানে এর আগে কোনও সাপ্লাই হয়নি বা ছিল না।’

মানহীন এসব পিপিই নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল-ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান ও পরিচালক (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) ডা. হাবিবুর রহমানকে একাধিকবার কল করে ও এসএমএস পাঠিয়েও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।