শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি (পর্ব-০৩)

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করতে হবে

khairul bashar

প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ,
অতি ক্ষুদ শত্রু করোনা ভাইরাসের মহামারিতে সংকটে পড়েছে বিশ্বে সাড়ে সাত’শ কোটি মানুষ। আর শুধু করোনা নয়, সকল মহামারির শেষ অভিঘাত এসে পড়ে খাদ্যের উপর। সুতরাং বৈশ্বিক করোনার মহামারির ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা ভাবতেই ভয়ে আঁতকে উঠতে হয়। মনে হয় এসব আঁচ করতে পেরেই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর চাইতেও বেশি মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যেতে পারে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৮২ কোটি ১০ লাখ মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ বিশ্বে তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ ভালো অবস্থায় থাকলেও, চল্লিশ লক্ষ হতদরিদ্র মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম। এই প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে দেশ-জাতিকে রক্ষা করার জন্য যেকোন মূল্যে কৃষি এবং কৃষি উপখাতের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে, সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে উৎপাদন বাড়াতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ তাদের সোনালী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কৃষি এবং কৃষি উপখাতের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় ধরণের অবদান রাখতে পারে।

২০১৮ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী , মাধ্যমিক, দাখিল, দাখিল(ভোকেশনাল) ও এসএসসি((ভোকেশনাল) স্তরে মোট ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ ৬ হাজার ৮৯৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যানুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৪৪লক্ষ ৫৬ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী (অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূতসহ)। এই হিসেবে দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটি ৮১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩২ জন। এরমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যাসুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী স্তরের শিক্ষর্থী সংখ্যা ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ৩৮ হাজার ১০০ জন। সুতরাং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী বাদ দিলে কৃষিকাজ করতে বা কৃষিকাজে সহায়তা করতে সক্ষম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ৮ লক্ষ ২৪ হাজার ৯৩২ জন। করোনা সংক্রমণের চলমান বৈশ্বিক মহামারীর দুঃসময়ে জনসংখ্যার এই বিরাট অংশেরও পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি দায় রয়েছে। তাই দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে, নিজে সচেতন থেকে পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠি, বন্ধু-বান্ধবদেরও করোনা সংক্রমণ থেকে সচেতন করে পিতামাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করতে হবে শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে বেশি বেশি করে কৃষিকাজে সাহায্য করতে হবে। কেননা, ফসল কর্তণ ও সংরক্ষণ এবং কৃষি উৎপাদন অব্যাহত না রাখতে পারলে করোনাকালে অথবা করোনা পরকর্তীকালে আরও ভয়াবহ বিপদ দেখা দিতে পারে।

এই সময়ে কৃষকদের বোরো ধান উঠানোর সময়। বাংলাদেশে সারা বছরে যে পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয় তার একটি বিরাট অংশ অর্থাৎ্ প্রায় অর্ধেক আসে বোরো মৌসুম থেকে। করোনার প্রাদুর্ভাবে গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। সেইজন্য অন্যান্যদের পাশাপাশি শিক্ষকদের নেতৃত্বে দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের কৃষি কাজে লাগতে হবে। শিক্ষার্থীরা সংকটকালীন এ সময়টাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি কমিউনিটি সার্ভিস হিসেবে তারা আপৎকালীন কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। শিক্ষার্থীরা এলাকাভিত্তিক টিম গঠন করেও কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এ বিষয়ে অনুধাবন করতে পেরে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ৩১ দফা বক্তব্যের মধ্যে তিনি দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিতে খাদ্যশস্য, সবজি এবং ফলমূল আবাদের বিষয়ে সবাইকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বোরো ধান আহরণে কৃষকদের সহযোগিতা করতে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

আশার কথা হল, সরকারের দেওয়া ধান কাটা যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার ও ধান কাটার শ্রমিকের সাথে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষকরে সিলেটের বিভিন্ন হাওরের বোরো ধান দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে শত শত কৃষক, গৃহস্থ, আনসার, পরিবহন শ্রমিক, মৎস্যজীবী, বারকি শ্রমিক, পাথর-বালুমহাল শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট-হোটেল শ্রমিক, কলকারখানার কর্মহীন শ্রমজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষকরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাটা, মাড়াই ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে। কৃষি শ্রমিকদের থাকার জন্য হাওরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। বলতেই হয়, এটি আশা জাগানিয়া এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সকলের প্রচেষ্টায় ০১ মে পর্যন্ত হাওরের প্রায় ৭৭ ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে জানিয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

তবে সারাদেশে বোরো ধান কাটার সময় এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। যারা আগাম বি-আর ২৮ ধান লাগিয়েছেন তারা এখন ধান কাটছেন। বিআর-২৯ পাকতে আরো কয়েকদিন লাগবে। সারাদেশে ধান কাটার মৌসুম শুরু হতে এখনো ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, সারাদেশে হিসাব করলে মাত্র ১৬ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। সুতরাং দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। আশাকরি, সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত চেষ্টায় বোরো ধান ভালোভাবেই কাটা সম্পন্ন হবে।

শুধু ধান কাটলেই হবে না। ধান পর্বিহন, মাড়াই, শুকানো, ঘরে তোলার কাজে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি বোরো পরবর্তী আউশ, আমন উৎপাদনসহ অন্যান্য কুষি উপখাতের উৎপাদন অব্যাহত রাখতেও সাহায্য করতে হবে। কারণ শুধু ভাত খেলেই পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে না। করোনা থেকে মুক্তি পেতে হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবারও খেতে হবে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল, ফল, শাক-সবজি, মসলার চলমান উৎপাদনও অব্যাহত রাখতে এবং উৎপাদন বাড়াতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতে হবে শিক্ষার্থীদের। ”একটু জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। ঘরের কোনায় হলেও কিছু ফসল ফলান, ফলমূল আবাদ করুন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে অল্প একটু জমিও যেন পড়ে না থাকে”, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আহবানে আমাদের সাড়া দিতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে, পারলে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে সকলকে উৎসাহ দিতে হবে। পিতার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ফসল ঘরে তুলতে, খাদ্য উৎপাদন কাজে নিজেদেরকে বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজেদের ঘরে উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকলেই কেবল অন্যকে সাহায্য করতে পারা যাবে। আর বিপদকালে বিপদাপন্ন মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েই আমাদের প্রমাণ করতে হবে, ’মানুষ মানুষের জন্য’। বাংলার আবহমান অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষিতে ফিরতে পারলে আশা করা যায়, করোনার মহামারি এবং এর প্রেক্ষিতে সৃষ্ট খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে না বাংলাদেশ। অভুক্ত থাকবে না এদেশের একটি মানুষও।

এস এম খায়রুল বাসার
গাংবাদিক, কলাম লেখক
অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয়
ইছামতি, অভয়নগর, যশোর।
[email protected]