করোনার চিকিৎসায় যেসব ওষুধের পরীক্ষা চলছে

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার নেয়া করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। নতুন করে করোনার জন্য ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছেন। তবে সেই ওষুধ পেতেও অনেক দেরি হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন রোগের ওষুধ দিয়ে করোনার চিকিৎসা করা যায় কি না সে বিষয়ে পরীক্ষা করছেন বিজ্ঞানীরা। চলুন দেখে নিই কোন কোন রোগের ওষুধ দিয়ে করোনার চিকিৎসার বিষয়টি যাচাই করছেন তারা।

  • কুষ্ঠরোগের ওষুধ সেপসিভ্যাক

ভারতের চন্ডিগড়ে করোনা রোগীদের ওপর কুষ্ঠরোগের ওষুধ সেপসিভ্যাক কাজ করে কি না তার পরীক্ষা চালাচ্ছে ভারতের এক ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট। এই ওষুধে গুরুত্বপূর্ণ ইমিউনোমুডুলেটর রয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেলের রিসার্চে বলা হয়ে এই উপাদান গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। যদি এটি করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পরীক্ষায় সফল হয় তাহলে আরও বড় আকারে পরীক্ষা করা হবে।

  • হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন

একাধিক গবেষক বলছেন, ক্লোরোকুইন এবং এরই আরেকটি ডেরিভেটিভ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের অ্যান্টি ভাইরাস বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাময়িকভাবে শান্ত করে দিতে পারে। ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন তারা। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ওষুধ নিয়ে অতিউৎসাহ দেখানোর কারণেই এটি বেশি আলোচনায় এসেছে। যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হয়নি।

হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার পাশাপাশি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় ব্যবহার করা হয়, এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার বৈশিষ্ট্যের কারণে।গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ ওষুধ করোনাভাইরাসকে সংক্রমণ থেকে দমিয়ে রাখতে পারে এবং আরো বেশ কয়েকটি প্রমাণের ভিত্তিতে চিকিৎসকরা বলছেন, এটি করোনা রোগীর জন্য উপশমকারী হতে পারে।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটির কার্যকারিতার সপক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।

  • এইডস এর ওষুধের সঙ্গে সংমিশ্রন

দেখা গেছে সংক্রমণরোধী তিনটি ওষুধ ও মাল্টিপল স্কলেরোসিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের সমন্বিত প্রয়োগ নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের তুলনামূলকভাবে দ্রুত সারিয়ে তুলতে পারে। হংকংয়ের একদল চিকিৎসক এ তথ্য জানিয়েছেন।

ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে ওই চিকিৎসকরা লিখেছেন, তারা যে ওষুধগুলোর সমন্বয়ে করোনা রোগীর চিকিৎসার কথা বলছেন তা নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু এটিও চিকিৎসার একটি পদ্ধতি হতে পারে।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. কোকো-ইয়ুং ইউয়েন ও তার সহকর্মীরা কয়েকটি ওষুধের সমন্বয়ে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। তারা এইচআইভির ওষুধ রিটোনাভির ও লোপানিভির-এর সঙ্গে সাধারণ সংক্রমণরোধী ওষুধ রিবাভিরিন এবং মাল্টিপল স্কলেরোসিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ বেটা ইন্টারফেরন-এর সমন্বয় ঘটান।

গবেষকরা এমন রোগীদের বেছে নেন যাদের সবারই সাত দিন আগে (গবেষণার সময় থেকে) করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তাদের হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় উপসর্গ ছিল। ডা. ইউয়েনের সহকর্মীরা কিছু রোগীর ওপর শুধু এইচআইভির চিকিৎসায় ব্যবহৃত দু’টি ওষুধের প্রয়োগ করেন। বাকিদের ওপর এইচআইভির দু’টি ওষুধসহ সাধারণ সংক্রমণরোধী ও মাল্টিপল স্কলেরোসিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের ককটেল প্রয়োগ করা হয়।

যাদের ওপর ককটেল প্রয়োগ করা হয় তারা সাত দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠেন। আর যাদের ওপর শুধু এইচআইভির ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তারা ১২ দিন পরও করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। তবে এই চিকিৎসায় সামান্য কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

  • ফ্যাভিলাভির বা এভিগান

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি গ্রুপ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চিকিৎসা দেয়ার মত একটি ঔষধের ক্লিনিকাল বা মানব দেহে প্রয়োগের পরীক্ষা শুরু করেছে।নাফামোস্ট্যাট মেসাইলেট সাধারণত অগ্ন্যাশয়ের জটিলতা’সহ রক্ত জমাট বাধার মত অন্যান্য রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ফুথান ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করা হয়।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি শরীরে রক্ত জমাট বাধার পর করোনাভাইরাসবাহী অনেক ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার অবনতির কিছু খবর পাওয়া গেছে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়’সহ জাপানের অন্য পাঁচটি হাসপাতালে করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১শ ৬০ জন রোগীর উপর এই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।

রোগীদের দু’টি দলে ভাগ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি দলের উপর ফুথান এবং ভাইরাস রোধী এভিগান ঔষধ যৌথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর অন্য গ্রুপকে শুধুমাত্র এভিগান দেয়া হচ্ছে। গবেষকরা দেখতে চাইছেন, করোনাভাইরাস উপসর্গের চিকিৎসায় ফুথান কার্যকরী এবং নিরাপদ কিনা। তারা বলছেন, গবেষণাগার পরীক্ষায় দেখা গেছে এটি সম্ভবত ভাইরাসের বিস্তারকে দমন করতে পারে।

  • রেমডেসিভির

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আশাজাগানিয়া ওষুধ কোনটি সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ইবোলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেমডেসিভিরের সর্বশেষ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিস (এনআইএআইডি) দেখেছে, এই অ্যান্টি ভাইরাল ড্রাগ প্রয়োগ করলে করোনা উপসর্গের স্থায়িত্বকাল ১৫ থেকে ১১ দিনে নেমে আসে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন হাসপাতালের ১ হাজার ৬৩ রোগীর ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করে এমন ফল পাওয়া গেছে।

এনআইএআইডির প্রধান ড. অ্যান্থনি ফাউসি বলছেন, রোগীর দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে রেমডেসিভিরের পরিষ্কার, উল্লেখযোগ্য, ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

রোগীর সেরে উঠতে সহায়তা করে রেমডেসিভির এবং এ ওষুধের কারণেই সম্ভবত অনেককে ইনটেনসিভ কেয়ার পর্যন্ত নিতে হয় না- এ তথ্য ঠিক। কিন্তু এ পরীক্ষার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার নয় যে এ ওষুধ করোনাভাইরাসে মৃত্যু ঠেকাতে পারে কিনা।

গবেষকরা মনে করছেন, অ্যান্টি ভাইরাল ড্রাগ আক্রান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো কাজ দেয়। আর মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে ভালো কার্যকর ইমিউন ড্রাগ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেকটি ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সঙ্গে সলিডারিটি ট্রায়াল চালিয়ে যাচ্ছে রেমডেসিভির তার মধ্যে একটি। এই ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি গিলিয়াডও পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

  • প্লাজমা থেরাপি

কভিড-১৯ থেকে সের ওঠাদের রক্ত দিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকে আশাবাদী। কারণ যারা সেরে উঠছেন তাদের রক্তে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের লোকদের রক্তরস আক্রান্তের শরীরে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ভাইরাস ধ্বংস করার কৌশল কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ৫০০ রোগীকে এই থেরাপি দিয়েছে। কলভালসেন্ট প্লাজমা নামের এই থেরাপি এখন অন্যান্য দেশেও ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।

তবে কোন ওষুধ করোনাভাইরাসে বিরুদ্ধে কার্যকর এটি এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ ওষুধগুলোর ট্রায়াল চলছে মাত্র কয়েক মাস ধরে। কার্যকারিতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে হলে আরো কয়েক মাস ট্রায়াল চালিয়ে যেতে হবে।