মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন-এমন খবরে দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। একজন সাংসদ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে বিদেশে গ্রেপ্তার হওয়াকে দেশের জন্য কলঙ্ক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। কুয়েতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে তাদের ইমেজ চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ওরফে কাজী পাপুল মূলত আলোচনায় আসেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে। অর্থের বিনিময়ে মহাজোট প্রার্থীকে বসিয়ে দিয়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কয়েক মাস আগে কুয়েতের আল কাবাস ও কুয়েত টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে মানবপাচার ও ভিসা-বাণিজ্যের একটি চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশি সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের জড়িত থাকার কথা বলা হয়। দুই দেশের একাধিক দৈনিক পত্রিকায় কুয়েতি পত্রিকার বরাত দিয়ে পাপুলের কুয়েতের মানবপাচারের খবরটি প্রচারিত হয়। এসব খবরে বলা হয়, মানবপাচারের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই এমপি।
কাজী শহীদ ইসলাম পাপলু ১৯৬৩ সালের ২৮ মে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ও মাতার নাম তহুরুন নেছা। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম।
পাপলু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকার মিরপুরে তার বড় ভাইয়ের বাসায় এসে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তিনি পড়াশোনার জন্য সাইপ্রাস চলে যান। সেখান থেকে ৯৩ সালে কুয়েত গিয়ে একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। এর কিছুদিন একজন ভারতীয় পার্টনার নিয়ে কয়েকজন লোককে নিয়ে ক্লিনিংয়ের ব্যবসা শুরু করে। এরপর তিনি বাংলাদেশ থেকে ক্লিনার হিসেবে লোক নেয়া শুরু করেন কুয়েতে। জনপ্রতি আসা-যাওয়ার খরচ কুয়েতে মালিকের কাছ থেকে দেয়া হলেও তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রতিটি লোকের কাছ থেকে আনা নেয়ার খরচ নিতেন। তার ভাই চাচাতো মঞ্জু রায়পুর উপজেলা কমিটির বিএনপির সভাপতি। কুয়েতে গিয়ে সেলিনা নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে সেলিনাকে বিয়ে করে একসঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। সেলিনা ইসলাম ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা এনে আট কোটি টাকার বন্ড দেখিয়ে সিআইপি হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের শেষের দিকে কুয়েত প্রবাসী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। ওই সময়ে তিনি রায়পুর পৌর শহরের আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাকি বিল্লাহের হাত ধরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সভায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করাসহ মানবসেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার ঘোষণা দেন তিনি। পরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরসহ সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ব্যাপক আর্থিক অনুদান দেয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে সর্বমহলে দানবীর ও ধনকুবের হিসেবে পরিচিতি করাতে সক্ষম হন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইলেও পাননি। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এই আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়া জাতীয় পার্টির তৎকালীন সাংসদ নোমান হঠাৎ আত্মগোপনে চলে যান। তখন অভিযোগ ওঠে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান নোমান। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আসনটিতে জয়লাভ করেন পাপুল। এর কিছুদিন পর তার সহধর্মিণী সেলিনা ইসলাম স্বতন্ত্র কোটায় সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৯ ও ২০২০ সালে পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচার ও হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছেন বলে কুয়েতের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়। কুয়েতের সংবাদমাধ্যম আল-কাবাসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে মার্কিন বাসিন্দার সঙ্গে আর্থিক অংশীদারিত্ব গড়ে কুয়েতে আয় করা বেশির ভাগ অর্থ পাপুল আমেরিকায় পাচার করেছেন বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। যদিও পাপুল এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন।
অভিযোগ রয়েছে, এমপি পাপুল নিজের নামে কিছুই করেন না। তিনি বিভিন্ন সাব-এজেন্টের মাধ্যমে মানবপাচার করিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ক্লিনিং এবং সিকিউরিটির কাজের নামে তিনি এই মানবপাচার করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাপুল যে শুধু অবৈধ পথে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তা নয়, তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন সব জায়গাতেই নিজের তথ্য গোপন রেখে ব্যবসা করেন।
দেশেই জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত দিগন্ত টিভি, নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত মিডিয়ায় তিনি পরিচালকের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তিন কোটি টাকার বিনিময়ে। অবশ্য এই টাকা তিনি তার ব্যাংক হিসাব থেকে দেননি। তথ্য প্রমাণ না রাখতে নিজের শ্যালিকার হিসাব মাধ্যমে লেনদেন করেছেন।