দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতি : ভারত কি আধিপত্য হারাচ্ছে?

অতিসম্প্রতি নতুন করে দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল বা ভারত-চীন সীমান্তের গালওয়ান উপত্যাকায় উভয় দেশই যুদ্ধাংদেহী অবস্থানে দাড়িয়ে আছে। ১৯৬৭ সালের চীন- ভারত যুদ্ধের পর এটাই উভয় দেশ সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে মুখোমুখি দাড়িয়েছে। সর্বশেষ নিরস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল সমমানের অফিসার সহ ২০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। আহত অনেক। চীনা সৈন্যরা ১০ জন সৈন্য আটক করে রেখেছে। অপরদিকে চীনের ৫ জন সৈন্য নিহত হয়েছে এবং ৪০ জনের বেশি সৈন্য আহত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ভারত-চীন সীমান্তের সিকিম অংশেও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

চীন-ভারতের এই সীমান্ত সমস্যা নতুন নয়। এটা ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু। যতদিন উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চালু ছিল ততদিন চীন উপমহাদেশীয় অংশে সেভাবে তার সাম্রাজ্যবাদী চেহারা দেখানোর ততটা দুঃসাহস দেখায়নি কিন্তু ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পর পরই চীন উপমহাদেশের দিকে তার সাম্রাজ্যবাদ বাড়ানোর দৃষ্টি দেয়। দীর্ঘদিন থেকেই তিব্বত সমস্যার পাশাপাশি চীন ভারতের অরুনাচল প্রদেশকে তাদের অংশ দাবি করে থাকে। এমন কি সিকিম আর লাদাখকেও তাদের অংশ দাবি করে থাকে। এবার তো সরাসরি গালওয়ান উপত্যাকার মালিকানাও চীন দাবি করে বসল। এ দাবির কারন হল এসব এলাকার সিংহভাগ জনগোষ্টী বৌদ্ধ ধর্মের অধিবাসী এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবে চীনাদের সাথে বেশ সাদৃশ্য আছে। চীনারা সিংহভাগই বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী অপর দিকে ভারত ধর্ম-সংস্কৃতির দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ। এই বৈচিত্র্য এর কারনে ভারতকে নানা সময়ে অভ্যন্তরীন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

ভারত এবং চীন উভয়েই আঞ্চলিক পরাশক্তি। তবে বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার বাসনা নিয়ে এই দুই দেশই বহুকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যদি পরাশক্তিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাবো নিকট প্রতিবেশির সাথে সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন দেশই পরাশক্তি হতে পারেনি। সব দেশকেই নিকট প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়েছে। দিতে হয়েছে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার। ঠিক এইখানেই ভারত ৯০ শতাংশ এবং চীন ৪০ শতাংশ ব্যর্থ।
তবে আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিঃ ভারত কি আধিপত্য হারাচ্ছে? এজন্য চীনের ব্যাপারটি উহ্য থাক। পরে সংগত কারনে এসেই যাবে।

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই যদি আমরা দেখি ভারতের সাথে পাকিস্তানের সমস্যা লেগেই আছে। কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সহ প্রায় প্রতিদিনই লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি হয়, সৈন্য মারা যায়। বলা যায় দুই দেশ দুই দেশের জন্ম শত্রু যা কোনদিনও মিটবার নয়। দীর্ধদিন ভারত পাকিস্তানকে দক্ষিন এশিয় ফোরামে একঘরে করে রেখেছে দক্ষিন এশিয়ার অন্যদেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক বজায় রেখে। দক্ষিন এশিয়ার অবশিষ্ট সাতটি দেশের মধ্যে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের সাথেই পাকিস্তানের যা একটু সম্পর্ক আছে। যেটা ভারত আফগানিস্তান আরো বেশি। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” সবচেয়ে বেশি সক্রিয় আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে। এছাড়া পাক-আফগান সীমান্ত পাকিস্তানের উপজাতি এবং স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় পাকিস্তানের মোট সামরিক শক্তির ৫০ শতাংশ আফগান সীমান্তে মোতায়েন রাখা লাগে। তবে অতি সম্প্রতি পাক সেনাপ্রধানের কাবুল সফরের পর পাক-আফগান সম্পর্ক আরো বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে এবং আফগান-দিল্লি দূরত্ব বাড়বে। কেননা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পাক-আফগান বেশ ঘনিষ্ট। এছাড়া কাবুলের নতুন সরকার সকল প্রতিবেশির সাথে সমান সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। এতে করে কাবুলের উপর দিল্লির নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কমে যাবে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর সেখানে তারা আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে আগ্রহী নয়, এতে করে দিল্লিও অসুবিধায় পড়ে গেল। দক্ষিন এশিয়ায় ভারত-মার্কিন সম্পর্কে আফগানিস্তান বেশ ভালো একটা লিভারেজ দিত যেটা ভারত এখন আর পাবেনা।

জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের সাথে দুই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের সাথে খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় ছিল। ভারত দীর্ঘদিন শ্রীলংকায় তামিল টাইগারদের কে সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে কলম্বোর রাজনীতিকদের উপর শাসক সূলভ একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। শ্রীলংকার তামিলদের সাথে ভারতের তামিলনাড়ৃর অধিবাসী তামিলদের আদিকালের আত্নীয়তা-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এক্ষেত্রে ভারতকে বেশ একটা রাজনৈতিক সুবিধা দিত। তবে তামিল বিদ্রোহের অবসানের পর কলম্বোর উপর ভারতের প্রভুসূলভ সম্পর্কের সমাপ্তি হয়। সাম্প্রতিক কালে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্রায়ে চীন সরকারও কলম্বোর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ট করেছে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ সহ শ্রীলংকার বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণ মোটামুটি কলম্বো-দিল্লি সম্পর্ককে স্রেফ একটা রুটিন প্রতিবেশির সম্পর্কে পরিণত করেছে।

এছাড়া মালদ্বীপে দীর্ঘকাল দিল্লি প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক পালাবদলে সহায়তা করে নিজ ঘনিষ্ট সরকার চালু রাখতে সহায়তা করেছে যা দীর্ঘকাল দিল্লিকে দক্ষিন এশিয়ায় মালের ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে পেতে সহায়তা করেছে এবং দিল্লি দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিতে সব সময়ই মালের অকুন্ঠ সহায়তা পেয়ে এসেছে। তবে সাম্প্রতিককালে মালদ্বীপের নতুন সরকারও সব প্রতিবেশির সাথে সমান সম্পর্ক বজায় রেখে ভারতমুখীতা ত্যাগ করে রাজনীতিতে পশ্চিমামুখী হয়েছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একতরফা ভারতনীতি ত্যাগ করেছে। ফলে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কও মোটামুটি মধুচন্দ্রিমা হতে বের হয়ে দায়সারা সম্পর্কে পরিণত হয়েছে।

ভারত-চীন সীমান্তের নিকট প্রতিবেশি ভুটান-নেপালের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক দীর্ঘকালের। কয়েকবছর আগের ডোকলাম ইস্যু টুকু বাদ দিলে ভুটানের সাথে ভারতের এখনও সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও নেপালের সাথে সম্প্রতি ভারতের দীর্ঘকালের মধুচন্দ্রিমা সম্পর্কের অবসান ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন দীর্ঘ্কাল ধরে নেপালের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা করে গেছে এবং কয়েকবছর আগে চীনের প্রস্তাবিত সিল্করুট প্রকল্পে নেপাল ও যোগ দিয়েছে। এর পর থেকেই কাঠমান্ডুর সাথে দিল্লির সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এছাড়া নেপালের বেশ কয়েকটি বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে চীন কাজ করে যাচ্ছে ফলে নেপাল ও এখন ভারত ছেড়ে চীনমুখি হচ্ছে। এর ফলাফল দেখা গেছ অতিসম্প্রতি। দীর্ঘকাল ধরেই ভারত-নেপাল সীমান্তে কোন বেড়া নেই, সীমান্তও মোটামুটি অমিমাংসিত। উভয় দেশের সীমান্তবর্তী জনগন আত্নীয়তার সুবাদে কোন প্রকার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করে থাকে। তবে সম্প্রতি নেপালের সংসদে ভারত-নেপাল অমিমাংসিত বির্তকিত এলাকা সংযুক্ত করে মানচিত্র পাশ করেছে যা ভারতের জন্য বেশ অপমানজনক। এছাড়া নেপালী পুলিশ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় গুলি ছুড়ে ভারতীয় নাগরিক হত্যা করেছে এবং কয়েকজনকে আটক করেছে। অর্থাৎ নেপাল ও এখন সীমান্তে ভারত কে চাপে রাখতে চায়। আপাত দৃষ্টিতে এটা নেপাল-ভারত সমস্যা মনে হলেও এর পেছনে আছে চীনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। চীন পেছন থেকে নেপালকে উস্কে দিয়ে ভারতের মুখোমুখি করে দিয়েছে। ফলাফল ভারত-নেপাল বহুকালের বন্ধুত্ব সমাপ্তির দিকে।

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে সবচেয়ে যে নামটি আসে সেটি হল ভারত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববাসীদের মধ্যে বলা যায় প্রায় পুরাটাই ভারতের অবদান। এমনকি অন্যান্য দেশও বাংলাদেশকে যা সহায়তা করেছে সেটিও ভারতের মাধ্যমে। এবং বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত স্থলবেষ্টিত হওয়ায় মিয়ানমারকে বাদ দিলে বলা যায় বাংলাদেশের একমাত্র সু এবং কু প্রতিবেশি ভারতই। জন্মের ইতিহাসের সাথে জড়িত থাকা, বানিজ্যে ভারত নির্ভরতা, অধিকাংশ সীমান্ত নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ, দুই দেশের অধিবাসীদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সহ আত্নীয়তার সম্পর্ক বিদ্যামান থাকায় বলা যায় ভারতের সবচেয়ে আপন প্রতিবেশি বাংলাদেশ। তবে অভিন্ন নদীসমূহের একতরফা পানি প্রত্যাহার, সীমান্তে সাধারন মানুষের হত্যাকান্ড, বানিজ্য বৈষম্য সহ অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপকে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগন ভালো চোখে দেখেনা এবং এক্ষেত্রে একটা প্রবল ভারত বিদ্বেষ কাজ করে। এছাড়া বাংলাদেশের সব সরকারই সবসময়ে ভারত এবং চীনের সাথে ব্যালেন্সিং সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করে কেননা বাংলাদেশের আমদানি বানিজ্য প্রায় পুরাটাই ভারত এবং চীন নির্ভর। তাছাড়া বহুবছর থেকে চীন অবকাঠামোগত এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘনিষ্ট অংশীদার। তবে ভারত-চীন দ্বন্দ্বের ভেতরেই চীন বাংলাদেশকে দীর্ঘদিনের অমিমাংসিত ৯৭ শতাংশ পন্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে যেটা খোলা চোখে চীন-বাংলাদেশ আরো কাছাকাটি হওয়ার একটা চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। যেহেতু চীনের সাথে বাংলাদেশের কোন স্থল সীমান্ত নেই কাজেই বানিজ্যিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশকে কাছে টেনে চীন ভারতকে দক্ষিন এশিয়ায় একঘরে করার একটা চেষ্টা দীর্ঘদিন থেকেই চালাচ্ছে। এছাড়া ভারত বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্ক এবং অংশীদারিত্ব বজায় রাখলেও চীন এক্ষেত্রে কৌশলী। চীন সবসময়েই বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক বজায় রাখে।

দক্ষিন এশিয় রাজনীতিতে একটা বড় সম্ভাবনা ছিল সার্ক। সার্ককে কার্যকর রাখতে পারলে বড় প্রতিবেশি হিসেবে ভারতই সবসময়েই সার্কের নিয়ন্ত্রন রেখে সকল সার্ক সদস্যের উপর সার্ক কে দিয়েই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল দক্ষিন এশিয়ার সকল দেশকে ভারতের সমান গুরুত্ব প্রদান, দেশগুলোর অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করা, প্রতিবেশি দেশসমূহের জনগোষ্টীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু পাকিস্তানকে দক্ষিন এশিয়ায় একঘরে করে রাখতে গিয়ে ভারত সার্ক কার্যকরে সবসময় অসহযোগীতা করে এসেছে যার ফলাফল এখন ভারত নিজেই হাতেনাতে টের পাচ্ছে। ভারত নিজেই প্রচ্ছন্নভাবে পুরো দক্ষিন এশিয়ায় একঘরে হয়ে গেছে এবং এর সুযোগ নিয়ে চীন দক্ষিন এশিয়ায় তার আধিপত্য বাড়াচ্ছে।

সামগ্রিক ভাবে বলা যায় ভারত এর শাসকেরা প্রতিবেশিদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ন গিভ এন্ড টেক পলিসি থেকে সরে এসে অনলি টেক পলিসি গ্রহণ করায়, প্রতিবেশি দেশগুলোর অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করায়, বানিজ্য বৈষম্য বজায় রাখায় নিকট প্রতিবেশিদের আস্থা হারিয়েছে এবং প্রচ্ছন্নভাবে দক্ষিন এশিয়ায় একঘরে করে ফেলেছে। সোজা কথায় দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত তার আধিপত্য হারাচ্ছে। এটার সুযোগ নিচ্ছে চীন এবং আগামীদিনে এটার ফলাফল হিসেবে ভারতকে আরো সমস্যায় পড়লে হবে। দক্ষিন এশিয় লিডারশিপের আর্মব্যান্ড ভারত থেকে অন্যকোন দেশে চলে যাবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
মতামত দিন[email protected]