আসাদুল নয়, রবিউলই ইউএনওর ওপর হামলা করেছে

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী শেখের ওপর হামলার ঘটনায় আসাদুল নয়, রবিউল ইসলামই জড়িত বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ঘটনাটি তদন্তে শতভাগ সফলতার দাবি করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল ইসলামের দেয়া বক্তব্য, আলামত, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ঘটনার বর্ণনা সবগুলোই একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই ঘটনার সঙ্গে শতভাগ রবিউলই জড়িত এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরে অনেকটাই স্বস্তিতে দিনাজপুর পুলিশ।

ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনার পর থেকে জেলা পুলিশের সব কর্মকর্তারই প্রায় নির্ঘুম রাত কেটেছে। কেউ কেউ ১৮ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেছে। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ।

প্রথম অবস্থায় র্যাবের দাবি করা আসাদুলকে সাতদিনের রিমান্ডে নিলেও চারদিনই তিনি বলেছেন যে, ঘটনাটি তিনিই ঘটিয়েছেন। কিন্তু তার কথার সঙ্গে ফুটেজ, আলামত বা বর্ণনা কিছুরই মিল পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি যাদের কথা বলেছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো ক্লু পায়নি পুলিশ। অবশেষে আসাদুলকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার পর চতুর্থ দিনে তিনি বলেছেন যে, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।

এ সময় পুলিশ আসাদুলের কাছ থেকে তদন্ত কার্যক্রম সরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে কাজ শুরু করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কাদের দ্বিমত আছে বা কারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট তা খুঁজতে থাকে পুলিশ। যাকেই সন্দেহ হয়েছে এবং তার সঙ্গে দ্বিমত বা অসন্তুষ্ট থাকতে পারে মনে হয়েছে তাকেই জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এ ঘটনা তদন্তে পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রমে পুলিশ মহাপরিদর্শকের একজন স্পেশাল কর্মকর্তাকে এই কাজে ট্যাগ করে দেয়া হয়েছিল। ইউএনওর সঙ্গে দ্বিমত তা তার প্রতি অসন্তুষ্ট এমন বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও যখন কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছিল না তখন পুলিশের সামনে আসে রবিউল ইসলামের সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার বিষয়। এরপর রবিউলকে নিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।

কিন্তু কোনোভাবেই সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে একটি মোবাইল নম্বর পায় পুলিশ। যেটিতে দিনাজপুরের বিরল থেকে ঘোড়াঘাট যাওয়ার লোকেশনগুলো দেখাচ্ছিল। কিন্তু এই নম্বরটি রবিউলের কি-না এটি নিশ্চিত হতে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রবিউলের স্ত্রী বারবার বলছিলেন যে তার স্বামী জড়িত না, কিন্তু মোবাইল নম্বরটির কথা বললে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। পরে বিভিন্ন উপায়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে রবিউলই সেদিন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এরপর রবিউলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি যে ঘোড়াঘাটে গিয়েছিলেন সেসব তথ্য জানানোর পর রবিউল হামলার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্তার কথা স্বীকার করেন।

রবিউল ইসলাম হামলার সঙ্গে প্রকৃতই জড়িত কি-না বা তার সঙ্গে আর কেউ ছিল কি-না সেটি জানতে পুলিশ মেলাতে শুরু করে যে তিনি কোন স্থানে কতক্ষণ সময় অতিবাহিত করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে কোথায় কত সময় অতিবাহিত করেছেন এবং এসবের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন রবিউল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে রবিউলের কথার মিল খুঁজে পায় পুলিশ। তিনি একে একে ঘটনার বিবরণ দেন।

সেদিন রবিউল একটি স্থানে ১০ মিনিট অতিবাহিত করেছিলেন। কেন সেখানে ১০ মিনিট ছিলেন- এমন প্রশ্নে তিনি জানান যে, তার প্যান্টে কাঁটাতার আটকে গিয়েছিল। ফুটেজে দেখা গেছে যে, তার হাতে লাঠি ছিল। কিন্তু হামলা করেছেন হাতুড়ি দিয়ে, তাহলে লাঠি ছিল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন যে, রাস্তায় গভীর রাতে কয়েকটি কুকুর থাকে। যাতে করে কুকুর তাকে আক্রমণ না করে, সেজন্য তিনি লাঠি নিয়েছিলেন। পরে পুলিশের কর্মকর্তারা গভীর রাতে ঘোড়াঘাটের ওই রাস্তায় গিয়ে নিশ্চিত হয়েছে যে আসলেই সেখানে কয়েকটি কুকুর থাকে।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৩০ জনের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে নতুন করে আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকের প্রয়োজন দেখছে না পুলিশ। গত ৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে নিজ বাড়ি থেকে রবিউলকে আটক করে পুলিশ। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি হাতুড়ি, আলমারির চাবি, মই ও লাঠি উদ্ধার করা হয়।

তবে রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, সেদিন তিনি যেসব কাপড়, টুপি ও মাস্ক পরে ছিলেন, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলেছেন। আর এ জন্যই সিসি ক্যামেরায় তার হাতে একটি ব্যাগ দেখা গিয়েছিল যেই ব্যাগে নতুন জামা-প্যান্ট ছিল। পরিকল্পনা ছিল যে যেসব কাপড় পরে আছেন হামলার পর সেগুলো পুড়িয়ে ফেলে ব্যাগে থাকা জামা-প্যান্ট পরে বাড়িতে ফিরবেন। যাতে কোনো আলামত না থাকে। তিনি সেই মোতাবেকই কাজ করেছেন।