নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক, বাড়ছে শিশুমৃত্যু

বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না বলে উঠে এসেছে আইসিডিডিআর,বি এবং ম্যাসাচুসেটস জেনেরাল হসপিটাল-এমজিএইচের যৌথ গবেষণায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কম বয়সী শিশুদের চিকিৎসায় প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক ‘কাজ না করায়’ অনেক শিশুর মারা যাচ্ছে।

আইসিডিডিআর,বি এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল- এর গবেষকদের পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফল ‘ওপেন ফোরাম ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে’ প্রকাশিত হয়েছে।

আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।

ঢাকার আইসিডিডিআর, বি-র হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে কম বয়সী শিশুদের হার যখন বাড়ছে, তখন মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি এই গবেষণা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।

ড. চিশতি জানান, আইসিডিডিআর, বি- হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসতন্ত্রের উন্নততর চিকিৎসা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণেও নিউমোনিয়া হতে দেখা যায়।

নিউমোনিয়া হল ফুসফুসের একটি সংক্রমণ, যার ফলে এর বায়ু থলিগুলোতে তরল পদার্থ ও পুঁজ জমা হয়।এতে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এই সংক্রমণ প্রাণহানিকর হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ-আয়ের দেশে স্ট্যাফিলোকক্কাস (স্ট্যাফ), স্ট্রেপটোকক্কাস (স্ট্রেপ) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়া হল নিউমোনিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, যা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম হয়। শেষের দুটি জীবাণুর ক্ষেত্রে টিকা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য জীবন রক্ষা করেছে।

ড. চিশতি এবং তার সহকর্মীরা ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী চার হাজারের বেশি শিশুর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষা করেছেন।

গবেষণায় তারা দেখতে পেলেন, তাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়াজনিত ভিন্ন ধরণের সংক্রমণ ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী সাধারণ স্ট্যাফ ও স্ট্রেপের কারণে সংঘটিত সংক্রমণের হার এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শিশুর মধ্যে যাদের পজিটিভ কালচার ছিল তাদের মধ্যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া ৭৭ ভাগ সংক্রমণের জন্য দায়ী ছিল। এসব জীবাণুর মধ্যে ছিল সিউডোমোনাস, ই. কোলাই এবং ক্লেবসিয়েলা।

এই গবেষণার অন্যতম লেখক ও ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল ফর চিলড্রেন-এর পেডিয়ট্রিক গ্লোবাল হেলথ বিভাগের প্রধান ড. জেসন হ্যারিস বলেন, ‘বোস্টনে আমি যে কাজ করি তার থেকে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুর্ভাগ্যবশত, এসব শিশুর মধ্যে আমরা যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দেখেছি সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।’

ড. হ্যারিস বলেন, ‘এসব গবেষণালব্ধ ফলাফল সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরে যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এটা এখন আর তাত্ত্বিক কোনো ব্যাপার নয়, বরং এই সমস্যা ইতোমধ্যেই শেকড় গেড়ে বসেছে।

ড. হ্যারিস বলেন, এসব শিশু ইতোমধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে অকালে মারা যাচ্ছে। একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি হবে।

আইসিডিডিআর, বি-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও এই গবেষণার জেষ্ঠ্য গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে সেগুলোর সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এদেশে যারা বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না, তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনতে পারে। অনেক মানুষ আমাশয়, সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো সাধারণ অসুস্থতায় নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে নিজেদের চিকিৎসা করে থাকে।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বৃদ্ধি করে উল্লেখ করে তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা হয়তো অ্যান্টিবায়েটিক ব্যবহারের যথাযথ তত্ত্বাবধান, বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তি নেই এমন মানুষদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের উন্নয়ন সাধন করে এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ-সংক্রান্ত সমস্যা হ্রাস করতে পারি।’

ড. হ্যারিস সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি এসব এবং অন্যান্য পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা না হয়, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের এই মারাত্মক সমস্যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

যখন বিশ্বের একটি অংশে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী রোগজীবাণু গড়ে ওঠে, তখন তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ যদি একটি জলোচ্ছাস হয়ে থাকে তবে উদ্ভবশীল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সমস্যা একটি বন্যার পানির মতো এবং বাংলাদেশের শিশুরা ইতোমধ্যেই এতে তলিয়ে যাচ্ছে। সূত্র : সমকাল