করোনাভাইরাস মানবদেহে সংক্রমণের পর অসংখ্যবার রূপ বদল করলেও এক বছরের বেশি সময় পর ভারতীয় ‘ডেলটা’ ধরনই বিশ্বব্যাপী মহামারির মাত্রা ভয়াবহ করে তোলে। এরপর মহামারি নিয়ন্ত্রণে টিকা যখন আশার আলো দেখাচ্ছে, তখনই আফ্রিকায় শনাক্ত হয় করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন।
গত ২৪ নভেম্বর আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় এ ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে সংক্রমণের তালিকায় প্রতিদিনই একের পর এক দেশের নাম যুক্ত হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বের ৯০ দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আফ্রিকার সাতটি এবং ইউরোপের দুটি দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩ থেকে ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউনসহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বিশ্বজুড়ে অপ্রত্যাশিত গতিতে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাইকে সতর্ক করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ওমিক্রনের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ আসছে।
বাংলাদেশেও জিম্বাবুয়েফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের শরীরে ওমিক্রনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এটির ঢেউ বাংলাদেশেও আসবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যদিও দু’জনের বাইরে এখন পর্যন্ত অন্য কারও শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়নি। দেশে ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। দ্রুত এ ঘাটতি দূর করে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এদিকে ওমিক্রনের সংক্রমণকে ডেলটার চেয়ে কম গুরুতর বলে কেউ কেউ ধারণা করছিলেন। কিন্তু এমন প্রমাণ পাননি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ওমিক্রন :ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের ঢেউ বইতে শুরু করেছে। ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউনে চলে গেছে।
কয়েকটি দেশের যাত্রীদের ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বাংলাদেশও আফ্রিকার সাতটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সময়ে তাদের দু’বার নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। জাপান আফ্রিকা থেকে ভ্রমণে আসা ব্যক্তিদের ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সময়ে তাদের চারবার নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে।
জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা নিজ দেশের নাগরিকদেরই কেবল প্রবেশের অনুমোদন দেবে তারা। ভারতও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে বড়দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন না করার আহ্বান জানিয়েছে।
এতে সাড়া দিয়ে অনেক দেশ বড়দিনের অনুষ্ঠানে না করা এবং কিছু দেশ সীমিত পরিসরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের বিষয়েও অনেক দেশ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা ওমিক্রনের লক্ষণ আছে এমন ১১ হাজার ৩২৯ জনের সঙ্গে অন্যান্য ধরনে সংক্রমিত প্রায় দুই লাখ মানুষের তুলনা করেন।
এতে দেখা যায়, লক্ষণের কথা জানানো ব্যক্তিদের পরীক্ষা করে যতজনকে পজিটিভ পাওয়া গেছে, তার অনুপাত বিবেচনায় অথবা সংক্রমিত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর অনুপাত বিবেচনায় ওমিক্রন ডেলটার চেয়ে কম গুরুতর এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষেধক টিকার দুই ডোজ গ্রহণের পর ওমিক্রন লক্ষণযুক্ত সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা শূন্য থেকে ২০ শতাংশ। আর বুস্টার ডোজের পর তা ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ হয়। এ ছাড়া ডেলটায় সংক্রমিত হওয়ার চেয়ে ওমিক্রনে সংক্রমিক হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৪ গুন বেশি।
আরেকটি ঢেউয়ের শঙ্কা, জোরালো প্রস্তুতির আহ্বান :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে যতটুকু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, এটি অত্যন্ত সংক্রমণপ্রবণ। দ্রুততার সঙ্গে ছড়ানোর ক্ষমতা এবং তীব্রতা বাড়াতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে দু’জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে।
সুতরাং এটির ঢেউ বাংলাদেশেও আসবে- এটি বলা যায়। এজন্য বিদেশ থেকে আগতদের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিদেশ থেকে আগতদের ক্ষেত্রে পিসিআর টেস্ট নেগেটিভ হয়ে প্রবেশ করতে হবে এবং সংক্রমণপ্রবণ দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সমকালকে বলেন, ওমিক্রনের ঢেউ আসার আশঙ্কা শতভাগ। ইতোমধ্যে আফ্রিকার সাতটি এবং ইউরোপের দুটি দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) পর্যায়ে রয়েছে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯০টি দেশে শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রন। সুতরাং এটি মনে করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়বে না। চীনের উহানে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর অনেকের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে আসবে না। কিন্তু মারাত্মক সংক্রমণ ছড়িয়েছিল।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশের প্রবেশদ্বারে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া প্রবেশ ঠেকানো এবং বিদেশফেরতদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক জমায়েত বন্ধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
দ্রুততার সঙ্গে জনসাধারণকে টিকার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় রূপ বদল করা ধরনের সংক্রমণ এড়ানো কঠিন হবে। পাশাপাশি রোগীর চাপ বাড়লে হাসপাতালগুলোতে যাতে চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায় সেজন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে ডা. মুশতাক মনে করেন।
তিনি বলেন, আগের দুটি ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সুতরাং এটির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত :ওমিক্রন মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, দেশে ওমিক্রন এখনও সেভাবে ছড়ায়নি।
এটি প্রতিরোধে মনোযোগ দিচ্ছি। বিমানবন্দরে স্ট্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরালো করা হয়েছে। সীমান্তেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আছে, সেগুলোতে জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হচ্ছে।
এতে করে ওমিক্রন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে আইসোলেশনে এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করা হবে।
তবে দেশে ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ ৯০ দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরছে না এবং স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। একই সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্র, রাজনৈতিক কর্মসূচি, বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়েছে। এজন্য ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
মন্ত্রী জানান, সারাদেশের মানুষ যাতে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ইউরোপের অনেক দেশে লকডাউন জারি করা হলেও সরকার এখন এমন পদক্ষেপে যেতে চাচ্ছে না।