খরশ্রতা চিত্রা এখন শুধুই খাল, তলদেশ দখল করে শুরু হয়েছে চাষাবাদ 

কখনও পাড় আবার কখনও তলদেশ দখল। পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় ভবন, পুকুর, আর তলদেশে চলছে চাষাবাদ। প্রভাবশালী দখলদাররা এভাবে চিত্র নদীটি প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে।

এখন দেখলে মনে হবে একটি সরু খাল। কয়েক দশকের ব্যবধানে নদীর ঝিনাইদহ অংশের ৪৩ কিলোমিটারের বেশিরভাগ জায়গা দখলদারদের দখলে চলে গেছে। নদীটি রক্ষায় কারো কোনো পদক্ষেপ নেই। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় দখল হিসেবে চিত্রা নদীর ঝিনাইদহ অংশে ৮ টি পুকুর উল্লেখ রয়েছে।

যেগুলো এক গ্রামের নিচে আছে। অবশ্য চিত্রা বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এটা হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। এই নদীর জায়গা দখল করে বাড়িঘর নির্মান করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে নদীর মধ্যে। বড় বড় গাছ লাগানো হয়েছে এই চিত্রার বুকে। নদীর মধ্যে পুকুর, বাগান এমনকি বাড়িঘরও রয়েছে।

যেগুলো অপসারনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সেগুলো তালিকায় নেই জানতে পেরে তারা হতাশা প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহ জেলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহি চিত্রা নদী। এই নদীটি চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনার নি¤œস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঝিনাইদহে প্রবেশ করেছে।

নদীটি আরো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ হয়ে মাগুরার শালিখায় গিয়ে নবগঙ্গা নদীতে মিশেছে। ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটির ঝিনাইদহ অংশ রয়েছে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার। এক সময় নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলতো। ব্যবসায়ীদের পন্য পরিবহনে চিত্রা নদী ব্যবহার হতো।

নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে আজকের কালীগঞ্জ শহর। এছাড়া নদী পাড়ে আরো গড়ে উঠেছে গান্না, চাপরাইল, মঙ্গলপোতা সহ ছোট ছোট বেশ কয়েকটি বাজার। বর্তমানে নদীটি দখল হয়ে অনেক স্থানে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

নদী এলাকায় দেখা গেছে কোটচাঁদপুরের তালসার থেকে কালীগঞ্জের শালিখা পর্যন্ত নদীর দুই পাড় অসংখ্য পুকুর কাটা হয়েছে। যেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। কালীগঞ্জ শহরের বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে চিত্রা নদীর ব্রীজ সংলঘ নির্মান শুরু হয়েছিল পাঁকা ভবন।

আপাতত বন্ধ আছে। এরই পশ্চিমে শিবনগর গ্রামের নিচে জনৈক মুক্তার হোসেন নদীর জায়গায় পাঁকা ঘর তৈরী করেছেন। মুক্তার হোসেনের দাবি এটা তারই জায়গা। শহরের মধ্যে থাকা সেতুটির (পুরাতন ব্রীজ) দুই পাশে মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেতুর পশ্চিমে নদীর দুই পাড়ে বড় বড় পাঁকা ভবন তৈরী করা হয়েছে।

এখানে নদীটি খালে পরিনত করা হয়েছে। সেতুর পূর্ব পাশেও দুই পাড়ে অসংখ্য পাঁকা ভবন। প্রবীন ব্যক্তি রেজাউল ইসলামের ভাষায় এগুলো সবই নদী ছিল। শহরের কালীবাড়িটির কিছু অংশ নেমে গেছে নদীর মধ্যেই। হাসপাতালের নিচে নদীর মধ্যে বিশাল বড় পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে বিশাল বিশাল গাছ।

পুকুরটির মালিক তরিকুল ইসলামের দাবি উপরে তাদের জমি। সেই সীমানা ধরে পুকুর কেটেছেন। নদীর মধ্যে কিছুটা গেলেও যেতে পারে। পুকুরটি নদীর শ্রোতের গতিপথ নয়, গোটা নদীটিই আড়াল করে দিয়েছে। নিশ্চিন্তপুর এলাকার নদীর মধ্যে একটি ঈদগাহও নির্মান করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল ইসরাম জানান, এই স্থানে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর পূর্বেও নদীর প্রবল শ্রোত ছিল।
নদীর প্রস্ত সম্পর্কে একের স্থানে একেক মাপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনিয়ন পর্যায়ের সহকারী ভুমি কর্মকর্তারা। কোথাও ১২০ থেকে ১৫০ ফুট আবার কোথাও ১১০ থেকে ১২০ ফুট রয়েছে।

একাধিক ইউনিয়ন সহকারী ভুমি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, চিত্রা নদীর প্রস্ত ১ শত ফুটের নিচে কোথাও নেই। যা বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ ফুটে এসে দাড়িয়েছে।

কোথাও কোথাও এরও নিচে চলে গেছে। দলখদাররা দখল করে নদীকে খালে পরিনত করেছে। সদর উপজেলার গান্না এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি সাবেক জনতা ব্যাংক আবেদ আলী গান্না বাজারের নিচে নদীর মধ্যে একটি পুকুর কাটেন।

তিনি মারা যাবার পর পরিবারের দখলে আছে। এই বাজারে মহি উদ্দিন, আলতাফ হোসেন সহ একাধিক ব্যক্তির পুকুর রয়েছে। কোটচাঁদপুর উপজেলার তালিনা এলাকায় নদীর পাড়ে পুকুর আছে শাহজাহান আলী, রওশন আলী সহ কয়েকজনের। অবশ্য রওশন আলীর দাবি এগুলো তাদের মালিকানা জায়গা।

ইকড়া সেতুর কাছে পুকুর কেটেছেন আব্দুল হামিদ। সদরের কাশিমপুর ও কোটচাঁদপুরের জালালপুর এলকায় নদীর মধ্যে বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে। সদর উপজেলার সুতি গ্রামের টিপু মন্ডলের একটি পুকুর রয়েছে নদীর পাড়ে। কালীগঞ্জ উপজেলার সিংদহ গ্রামের মতিয়ার রহমান, ইসাহক আলী, সিরাজুল ইসলাম,

লিয়াকত আলী, মিজানুর রহমান, মফিজ উদ্দিন, আফসার আলী ও মোঃ আব্দুল এর ৮ টি পুকুর আছে নদীর জায়গায়। সরেজমিনে সিংদহ গ্রামে গিয়ে ওই ৮ টি পুকুর দেখা যায়। পুকুরের পাড়ে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছও রয়েছে। যা দেখে বোঝা যায় এগুলো অনেকদিনের দখল।

কোটচাঁদপুরের তালসার এলাকায় দেখা গেছে জনৈক আব্দুল মালেক নদীর মধ্যে ধান চাষ করছেন। তিনি জানান, উপরের জমির মালিক, তাই নিচের জমিও তারই দখলে। এই স্থানে নদী এটা স্বীকার করে বলেন সবাই চাষ করছেন তাই তিনিও করছেন। তালসার গ্রামের আব্দুল করিম জানান, তিনি যে পর্যন্ত ধান চাষ করছেনে সবটুকু ব্যক্তি মালিকের জমি। তিনি ক্রয় সুত্রে জমির মালিক হয়েছেন।

ইতিপূর্বে এই স্থানে শ্রোত ছিল এটা স্বীকার করে বলেন, এখন এটা ব্যক্তি মালিকের। চিত্রা বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক শিবুপদ বিশ্বাস জানান, চিত্রায় অসংখ্য পুকুর আর ভবন রয়েছে। অথচ সরকারের দখলের তালিকায় এসেছে মাত্র ৮ টি পুকুর। বর্তমানে শুরু হয়েছে ধান চাষ।

এরা প্রথমে ধান চাষ করবেন, পরে বড় বড় গাছ লাগিয়ে দখল করবেন। তিনি বলেন, চিত্রাকে বাঁচাতে সকল সব ধরনের দখলদারকে উচ্ছেদ করতে হবে। এরপর নদী খনন এর মাধ্যমে তার পুরানো জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে।

ঝিনাইদহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাজিবুল ইসলাম খান জানান, চিত্রা নদীর অবৈধ দখলদারের একটা তালিকা তৈরী হয়েছে। এগুলো উচ্ছেদের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্য এতোদিন করা সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুতই তারা উচ্ছেদ অভিযানে নামবেন বলে জানান।

এছাড়া নদীর তলদেশে ধান চাষ সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোজ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের পরিচালক হারুন-অর রশীদ জানান, পুকুর ভরাট, জলাশয় ভরাট, নদী ভরাট আইনগত নিষিদ্ধ।

বিশেষ করে নদী ভরাট করলে নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। নদীর শ্রোত বাঁধাগ্রস্থ হয়। এতে নদীতে থাকা নানা প্রজাতির মাছ ধংস হয়ে। জীব বৈচিত্র হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, এগুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, তারাও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।