যে কারণে হেরে গেলেন সাক্কু

 

বহুল আলোচিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়িয়েছে। টান টান উত্তেজনার এই নির্বাচনে সাবেক দুবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু হেরে গেছেন। তাকে হ্যাটট্রিক জয়লাভ করতে দিলেন না নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরে নগরপিতার চেয়ার ছাড়তে হচ্ছে সাক্কুকে। সাক্কু ফল প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সেটি কতটুকু কাজে দেবে সেটিও ভাববার বিষয়।

 

বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পরাজয়ের কারণগুলো নিয়ে এখন নগরজুড়ে আলোচনা চলছে। টানা দুই মেয়াদের এ মেয়রের পরাজয়ে নেপথ্যে কোন কোন জিনিস কাজ করছে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

 

ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, সাক্কু এমন ফল হবে ঘূর্ণাক্ষরেও প্রত্যাশা করেননি। কুমিল্লার রাজনীতিতে ভোটব্যাংকের মালিক এই নেতা ভোটের আগমুহূর্তে রাজনৈতিক মেরুকরণ পাল্টে এমন হবে সেটি ভাবতেও পারেননি। দীর্ঘদিন যার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করেছেন, সেই বাহাউদ্দিন বাহার এমপি তাকে হারাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামবেন সেটিও ছিল সাক্কুর হিসাবের বাইরে। এর পরও নিজস্ব ভোটব্যাংক ও উন্নয়নের কারণে এ যাত্রায়ও নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে পারবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সাক্কুর। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যে দলের রাজনীতি করেছেন সেই দলটির বিরোধী পক্ষের ‘ষড়যন্ত্রে’ শেষ পর্যন্ত হারতে হলো সাক্কুকে। মেয়র পদে লড়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নিজামুদ্দিন কায়সার প্রায় ৩০ হাজার ভোট না কাটলে ‘এত কিছুর পরও’ সাক্কুর জয় ঠেকানো যেত না বলে মত স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

 

সাক্কুর হেরে যাওয়ার পেছনে মোটাদাগে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তারা। প্রথমত বিএনপির সমর্থন না পাওয়া। দ্বিতীয়ত স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহারের চরম বিরোধিতা। তৃতীয়ত বিএনপির একটি অংশ কায়সারকে সমর্থন দেওয়া।

 

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এটি ছিল তৃতীয় নির্বাচন। আগের দুবার ২০১২ ও ২০১৭ সালে সাক্কু মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে। ২০১২ সালে কুসিকের প্রথম নির্বাচনে মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ৭২ জন ভোট দিয়েছিলেন। ভোটের হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৬ শতাংশ। ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মনিরুল হক সাক্কু। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খান পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ২৯ হাজার ১০৬।

 

২০১৭ সালের নির্বাচনে কুসিকে ভোটার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। ভোট পড়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৬৯০। ভোটের হার ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিএনপির প্রার্থী সাক্কু ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানার নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। অর্থাৎ ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু।

 

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ছিল। তবুও সীমা হেরেছিল বিএনপির প্রার্থীর কাছে। সেময় পরাজয়ের কারণ হিসাবে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে সামনে আনা হয়েছিল।

 

এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং সাবেক মেয়র সাক্কু। এবার ভোটার ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০। ভোট পড়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৭৪৫টি। ভোট পড়েছে ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। আর সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন রিফাত। তবে ভোটের হার কমলেও ভোটার সংখ্যা বাড়ায় এবারের নির্বাচনে গত নির্বাচনের চেয়ে প্রায় দুই হাজার ভোটার বেশি ভোট দিয়েছে। গত নির্বাচনে সীমা পরাজিত হলেও এবারের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার ৫৫৩ ভোট বেশি পেয়েছিল নৌকা।

 

কুমিল্লার সাধারণ ভোটার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাক্কুর পরাজয়ের পেছনে স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী নিজাম উদ্দিনের প্রায় ৩০ হাজার ভোটপ্রাপ্তি একটি বড় কারণ। দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সেই ভোট দুজনের বাক্সে ভাগ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোট এভাবে ভাগ না হলে অধিকাংশ ভোট যেত সাক্কুর বাক্সে। সে ক্ষেত্রে তার পাওয়া ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোটের সঙ্গে আরও ভোট যুক্ত হতো। মেয়র পদে বেসরকারিভাবে জয়ী আরফানুল হক ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়েছেন।

 

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কুমিল্লা জেলার সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত মনিরুলের পরাজয় হয়। মনিরুল যে ভোট পেয়েছেন, তার অধিকাংশ সাধারণ ভোটারের ভোট। আর নিজাম উদ্দিনের বাক্সে গেছে