মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ মেঘাচ্ছন্ন

কোনো কোনো পর্যবেক্ষক ব্যক্তি হিসেবে জেনারেল নে উইনকে মিয়ানমারের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক শক্তি বলে বিবেচনা করতেন। আমিও সেই পর্যবেক্ষকদের একজন ছিলাম। মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, দলের চেয়ারম্যান এবং দেশটির সেনাবাহিনী তাতমাদোর কমান্ডার হিসেবে ক্ষতিকর উপায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যতটা নিচে নামা যায় ততটাই নেমেছিলেন। রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেছেন পুরো তাঁর খেয়ালখুশিমতো। মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করার পর তিনি এক দল সঙ্গী গড়ে তোলেন এবং তাঁদের সঙ্গে এক ধরনের প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি একদিকে নিজের গুরুত্ব বাড়ান, আরেক দিকে স্বেচ্ছাচারী শাসন চালানোর কর্তৃত্ব সংহত করেন। ১৯৬২ সালে নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ১৯৮৮ সালে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত কেউই তাঁকে জোরেশোরে কোনো ধাক্কা মারতে পারেননি।

তবে বর্তমান সামরিক জান্তাপ্রধান মিন অং হদ্মাইংয়ের উত্থানের পর আমি নে উইন সম্পর্কে ওই মূল্যায়ন পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ মিন নে উইনের সবক’টি বাজে বৈশিষ্ট্য ধারণ করছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি সমাজের ওপর সেই নিয়ন্ত্রণগুলো আবারও আরোপ করেছেন, যেগুলো গত এক দশকে ক্রমশ তুলে নেওয়া হয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার করেছিল। এ ক্যুর মধ্য দিয়ে তাতমাদোর একটা অংশ এবং সংখ্যাগুরু বার্মার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে যে ধ্বংসাত্মক শক্তি লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে নজিরবিহীন। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এ মুহূর্তে এ আলোচনা করতে গিয়ে আমার ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা মনে পড়ছে।

এটা খুব স্পষ্ট যে, ঔপনিবেশিক-পূর্ব যুগে এবং স্বাধীনতার সময় থেকে বার্মা বা মিয়ানমারে সামরিক-বেসামরিক সব আমলে ক্ষমতার চর্চা হয়েছে নেতাদের ব্যক্তিগত বিশেষাধিকার হিসেবে। যখনই পলিসির প্রশ্ন এসেছে তখনই রাজা বা প্রধানমন্ত্রী সবাই আইন ও প্রথার ওপর তাঁদের ব্যক্তিগত খেয়ালকে স্থান দিয়েছেন। আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার আধিপত্যের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সেখানে একটা মাত্র প্রতিষ্ঠানই শক্তিশালী হয়েছে, তা হলো সেনাবাহিনী। কিছুদিন আগেও সংঘের সিনিয়র সদস্যদের মতো ধর্মীয় নেতারা আম জনতার মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টির কাজ সীমা ছাড়িয়ে গেলে তার রাশ টেনে ধরতেন। এখন এসবের কোনো বালাই নেই। বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে রাজনৈতিক ক্ষমতাচর্চার প্রকাশ্য হাতিয়ার।

তবে এগুলোই শেষ কথা নয়। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারির ক্যুর বিরোধিতা করতে গিয়ে জনগণ সরকার পরিচালনার যে নজিরবিহীন ও ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা দেখিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার দিন ধীরে বা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও শেষ হতে চলেছে। এটা সত্য, এখনও কোনো গোষ্ঠী সম্ভাবনাময় কোনো নেতৃত্ব তুলে ধরতে পারেনি। তবে এটাও ঠিক, জনপ্রিয় নেতৃত্ব মানেই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ নয়। বর্তমান বিশ্বের চারদিকে এর বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। অং সান সু চি এক সময় বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতিরও অনেক ওপরে। এর মানে ব্যক্তির ক্ষমতার কাছে আইন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। ১৯৫০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইউ নু ক্ষমতাকে তাঁর ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজে লাগাতেন।
যেহেতু বর্তমানে আমরা মিয়ানমারে একটা বিশেষ পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি; দেশটির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কোনো রোডম্যাপ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সেখানে কেউই সেনাবাহিনী রচিত সংবিধানে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতিও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে হচ্ছে। তাতমাদো বর্তমানে এমন সব কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত, যা শুধু তাদের নয়, রাষ্ট্রেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। তাদের মধ্যকার যে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, তা গুজব বলেই লোকে বিশ্বাস করে। জাতীয় ঐক্যের সরকার বা এনইউজি জাতীয় তো নয়ই; ঐক্যবদ্ধও নয়। বৈচিত্র্যময় নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর উজ্জ্বল কোনো গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব না থাকলেও তারা সবাই এমন একটা দিনের আশায় আছে, যেদিন জাতিগোষ্ঠীর ভূমিকা, মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে।

পরিণাম যা-ই হোক; ২০২৩ সালের আগস্টে সেনা-কর্তৃত্বাধীন এবং প্রভাবাধীন যে নির্বাচন হওয়ার কথা আছে, তাই এখনও আলোচনায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কষ্টকল্পিত হলেও বেসামরিক বিরোধী শিবিরের কিছু অংশের সঙ্গে আপসরফার কথা শোনা যাচ্ছে। সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীগুলোর কারও কারও সঙ্গে আগের মতো একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টাও চলছে বলে জানা যাচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, কোনো পরিবর্তন হবে না; চলমান অরাজক পরিস্থিতিই বজায় থাকবে। এগুলোর যে কোনোটাই ঘটুক না কেন; ফল হবে একটা দুর্বল রাষ্ট্র, যার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে বা উদারমনা ও আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত বর্তমান যুবসমাজের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যে অক্ষম।

বৈচিত্র্যময় এবং পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মনে হচ্ছে, আত্মপ্রবঞ্চনা ও অপপ্রচারের জালে জড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে বিকল্প পলিসি প্রণয়নের পর্যাপ্ত বিবেচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্র ও অর্থনীতিগুলোর প্রভাব যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক; প্রতিবেশী বা অন্যান্য রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ন্ত্রণেও এদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর হতাশা নিশ্চয় বাড়বে। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তনে তার ভূমিকা অকার্যকরই থাকবে। জাতিসংঘ ও আসিয়ানের প্রভাব খুবই সামান্য। দেশটিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে জাতীয়তাবাদী উদ্বেগ সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই উল্লেখযোগ্যভাবে বিরাজ করছে। বিদেশি-বিদ্বেষও তখন থেকেই ব্যাপক রূপ ধারণ করছে। বিক্ষিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর কোনো একটিকে বাইরে থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা হলে আঞ্চলিক অস্থিরতা আরও বাড়ত; রাজনৈতিক উদারীকরণকেও তা প্রশ্নের মুখে ফেলত। এ সবকিছু গোপনে করা হলেও খুব দ্রুতই প্রকাশ হয়ে পড়ত। মোট কথা, বিদেশি যে কোনো হস্তক্ষেপ মিয়ানমার সরকারকে বলির পাঁঠা খুঁজে পেতে সাহায্য করত। তার পরও সেখানে মানবিক সহায়তা জরুরি হয়ে পড়েছে, যদিও যাদের তা প্রয়োজন তাদের কাছে ওই সহায়তা পৌঁছানো বেশ কঠিন ও জটিল।

কাজেই আমরা যারা মিয়ানমারের বিচিত্র জনগোষ্ঠীগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, তাঁরা খুবই গভীর হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে রাষ্ট্রটির সামনে একটা ধ্বংসাত্মক, হীন ও মেঘাচ্ছন্ন পথ অপেক্ষা করছে। দুঃখজনক হলেও আমাদের একটা নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে, যারা ক্ষমতায় যাবে প্রগতির স্বার্থে এবং যারা জনগণকে নিছক নেতাদের সংকীর্ণ স্বার্থের পরিবর্তে সামগ্রিক স্বার্থে বিবেচনা করবে।