বামপন্থিদের তিন ধারা, অবিরাম ভাঙা-গড়া

দেশে বামপন্থার রাজনীতিতে অনেক দল জনগণের মধ্যে কম প্রভাব নিয়ে রয়েছে এবং দল-জোটের ঘন ঘন ভাঙা-গড়া প্রায়ই দেখা যায়। এখন আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এক জোট ছেড়ে আরেক জোটে ভিড়ছে সরকারবিরোধী একাধিক বাম দল। নিজেদের আদর্শিক অবস্থান ঝাপসা করে ডানপন্থি শিবিরেও যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে সখ্য কারও কারও।

নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে একাধিক বামপন্থি জোট যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান দল বিএনপির চলমান আন্দোলনের সমান্তরালে বামপন্থিদের কার কী ভূমিকা দেখতে রাজনৈতিক মহল আগ্রহী।
বহু দলে বিভক্ত ও ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে ক্রমাগত জোট গঠনের চেষ্টারত বামপন্থিরা এখন রাজনৈতিক কৌশল প্রশ্নে মোটাদাগে তিনটি ধারায় কাজ করছে। প্রথমত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবিসহ ৬ দলের ‘বাম গণতান্ত্রিক জোটের’ আহ্বান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় আধিপত্যের বাইরে দেশে বাম বিকল্পশক্তি গড়ে তোলা। আশু ক্ষমতার স্বাদ নয়, বরং পরিবর্তনের দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য।

দ্বিতীয়ত, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না ও জোনায়েদ সাকির নিজ নিজ দল নিয়ে বাম ও মধ্যপন্থি ৭টি সংগঠনের নবগঠিত মোর্চা ‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ আওয়াজ আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে সংগ্রাম; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সরকার ব্যবস্থার সংস্কার’। তাড়াহুড়ো করে এই মোর্চা গঠনের পেছনে আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সম্ভাব্য বৃহত্তর ঐক্যের হিসাব-নিকাশ যুক্ত থাকতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগকে নিয়েই ‘১৪ দলে’ থাকা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু প্রমুখের কতিপয় দলের সরকার সমর্থক বাম। এর বাইরেও ছোট কিছু বাম শক্তি আছে।

বিশ্বব্যাপী বামপন্থি রাজনীতি বলতে বোঝায় সামাজিক সাম্যের লক্ষ্য নিয়ে ধনবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের পক্ষে লড়াই করা। আঠারো শতকে ফরাসি বিপ্লবের সময় পার্লামেন্টে বিরোধী দল স্পিকারের বাম পাশে বসা শুরু করলে শব্দটি চালু হয়। পরে সব দেশের পার্লামেন্টে বিরোধী দল বাম পাশেই বসছে; কিন্তু ক্রমে বামপন্থি শব্দটি সমাজতন্ত্রকামীদের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

অন্দোলন :বর্তমানে বাম শক্তির বৃহত্তম জোট বাম গণতান্ত্রিক জোট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ২৫ আগস্ট সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল পালনের ডাক দেয়। যুগপৎ রাজপথে ছিল প্রখ্যাত বামপন্থি নেতা বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ ‘৯ সংগঠন’ নামের আরেকটি জোট।

আরও চারটি দল যথাক্রমে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, সাম্যবাদী দল (এমএল), সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সমন্বয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ হরতালে সমর্থন দিয়ে মাঠে ছিল।
এ ছাড়া পৃথকভাবে বিএনপি এবং বামদের নবগঠিত ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ হরতালে নৈতিক সমর্থন দেয়।

এরপর ১১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম কমানোসহ ১০ দফা দাবি তুলে ধরে বাম গণতান্ত্রিক জোটটি কিছু কমর্সূচি পালন করেছে।

এভাবে বামেরা সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার সূচনা করলেও জোট ভাঙা-গড়ায় তারা জনমনে দাগ কাটতে পারছে না।
ভাঙা-গড়া :বাম গণতান্ত্রিক জোটে শুরুতে ছিল আটটি দল। দুটির সদস্যপদ স্থগিত হওয়ায় এখন আছে ছয়টি। সিপিবি ছাড়া বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ, নেতা খালেকুজ্জামান), বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ। জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন ও সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কিছুদিন আগে বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চে ঢুকেছে।
দেশে বামপন্থি দল ও সংগঠনগুলো এত বেশি ভাঙাভাঙি ও জোটের সংযোজন-বিয়োজনে থাকে যে, রাজনৈতিক রিপোর্টারদের পক্ষে হিসাব রাখা ও গতি অনুসরণ করা সহজ নয়। বাম গণতান্ত্রিক জোটের বর্তমান শরিকরা সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এক দলের একাংশের সঙ্গে অন্য এক বা একাধিক দলের খণ্ডাংশের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৃতীয় নামও ধারণ করেছে। এর বিস্তারিত বিবরণ বেশিদিন প্রাসঙ্গিক থাকে না।

বদরুদ্দীন উমর ও ফয়জুল হাকিম লালার নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ ‘৯ সংগঠনের’ অন্য আটটি দল হলো বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (নেতা মহিনউদ্দিন চৌধুরী), গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা, গণতান্ত্রিক জাতীয় গণমঞ্চ, কমিউনিস্ট ইউনিয়ন ও জাতীয় গণফ্রন্ট (নেতা টিপু বিশ্বাস)।

দেশে বামপন্থার রাজনীতি নিয়ে আলাপকালে এ বিষয়ে গবেষক ও প্রাবন্ধিক-লেখক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, বামপন্থি দলগুলোকে সবার আগে অতীতের ব্যর্থতার জন্য আত্মসমালোচনা করতে হবে। এরপর বিশ্ব ও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে নতুনভাবে ধারণ করে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। দেশের রাজনীতিতে করণীয় কী, জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যবস্থা কেমন চলছে বা এগুলোতে কী পরিবর্তন দরকার- এসব বিষয়ে দলীয় মতামত ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্য ছাপানো পুস্তিকা আকারে দেশবাসীকে জানাতে হবে। দেশবাসীর সামনে পরিস্কার কোনো বক্তব্য না দিয়ে গতানুগতিকভাবে চললে তো কোনো উন্নতি হবে না।

তবে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সমকালকে বলেন, বামপন্থিদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতা বড় বলে অপপ্রচার তারাই করে, যারা লুটপাট ও পুঁজিবাদের সমর্থক। এ দেশে বামপন্থিদের অবদান অনন্য অসাধারণ। এ দেশের জন্মই হচ্ছে একটি ‘র‌্যাডিক্যাল বাংলাদেশ’ হিসেবে। সেখানে বামপন্থিদেরই কৃতিত্ব। বামপন্থিদের সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে সফলতাই বেশি। তবে ভুলত্রুটি যে নেই, তাও নয়।

বিএনপির দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচিগত অবস্থানের সঙ্গে বামপন্থিদের অবস্থানের অনেকটাই মিল থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামীপন্থিদের অভিযোগ, বামপন্থি ও বিএনপির অবস্থানের মিল রয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, বামপন্থিদের অবস্থান আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে, বামপন্থিরা এখন এই দুই দলের বাইরে একটি বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রেখে দেশবাসীর স্বার্থরক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

গণতন্ত্র মঞ্চ :বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকে বেরিয়ে এসে বামপন্থি শক্তিকে দুর্বল করা হলো কিনা জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, একটি চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা, অবাধ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সুনির্দিষ্ট কিছু সাংবিধানিক সংস্কার প্রভৃতি নূ্যনতম দাবিতে আমরা রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনের ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এতে বামপন্থিদের আদর্শচ্যুতি কিংবা শক্তি ক্ষয় হওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই।

একই মত ব্যক্ত করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নূ্যনতম ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। কেবল বামপন্থিদের শক্তি ও ঐক্য দিয়ে জনগণের দাবি পূরণ করা যাবে না। এখানে বামপন্থি, মধ্যপন্থি, ডানপন্থি ও উদারপন্থি দল ও শক্তির ঐক্যও প্রয়োজন।

গণতন্ত্র মঞ্চে এই দুই দল ছাড়া আরও আছে আ স ম রবের জাসদ (জেএসডি), মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ, রফিকুল ইসলামের ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও হাসনাত কাইউমের রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

সরকার সমর্থক বাম :দেশের বামপন্থি দলগুলোর আরেকটি বড় অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে যুক্ত রয়েছে ২০০৫ সালের শুরু থেকেই। তবে বড় দলের ‘অবহেলা’ ও ‘অবমূল্যায়নের’ অভিযোগ তাদের। মাঝে ক্ষুব্ধ কয়েকটি দল আগামী নির্বাচন নিজস্ব প্রতীকে অংশগ্রহণের ঘোষণাসহ সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনাও শুরু করে। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের বৈঠক করে শরিকদের মান-অভিমান দূর করতে বলেন এবং নির্বাচনে ১৪ দল জোটগতভাবেই অংশ নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

১৪ দলীয় জোটে এখন সক্রিয় আছে ৯টি দল- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ, বাসদ (রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি সমকালকে বলেন, ২৩ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ১৪ দল এখনও প্রাসঙ্গিক। কেননা এখনও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৪ দলের সংগ্রাম পুরোপুরি সফলতা পায়নি। জোট নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও তাঁরা জোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধই থাকবেন।

জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটসহ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তিকে পুরোপুরি পরাজিত করা যায়নি, রাজনীতির মাঠ থেকে নিশ্চিহ্নও করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যাবর্তনের চলমান পর্বে ১৪ দল এখনও প্রাসঙ্গিক।