হারিয়ে যাচ্ছে ‘গরিবের ট্রেন’

ভাড়া তুলনামূলক কম। তবে ভ্রমণ আরামদায়ক ও নিরাপদ। তাই যাতায়াতে বেশিরভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ ট্রেন। নিম্নবিত্ত মানুষের ভরসা বেশি লোকাল ট্রেনেই। এসব ট্রেন প্রায় প্রতিটি স্টেশনে থামে। আবার সিট না পেলে দাঁড়িয়েও যান অনেকেই। এগুলো থেকে আয় খুব একটা কম হয় না। কিন্তু নানা কারণে লোকাল ট্রেন চালানোয় আগ্রহ নেই রেলওয়ের। একের পর এক লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ হচ্ছে। নতুন করে এগুলো চালু করায় মনোযোগ নেই কর্তৃপক্ষের। রেলওয়ে আন্তঃনগর ট্রেন নিয়েই বেশি মনোযোগী।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে ১৪টি রুটে ৪২টি লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকলেও নানা অজুহাত দেখিয়ে সেগুলো চালু করছে না রেলওয়ে। বন্ধ থাকা ট্রেনগুলোতে (লোকাল, মেইল ও কমিউটার) দিনে ১৫ লাখ থেকে ১৬ লাখ যাত্রী চলাচল করতেন। এসব ট্রেন না থাকায় কমে গেছে রেলের আয়ও। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলওয়ে যাত্রী পরিবহন ও আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, তার চেয়ে যাত্রী কমে যায় ২৫ শতাংশ। এতে আয় কমেছে ৩২ শতাংশ। এই চিত্র থেকেই বোঝা যায়, ট্রেন বন্ধ থাকায় শুধু যাত্রীরাই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রেলও।

ট্রেনগুলো বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে রেলওয়ে বরাবরই বলছে ইঞ্জিন ও কোচের (বগি) অভাবের কথা। এই সংকট কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত ট্রেনগুলো চালু করা যাবে না বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারির আগে ও পরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বহরে ৩০টি নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন এই অঞ্চলে ইঞ্জিনসংখ্যা ১৫৯। তবে এর একটি অংশ নিয়মিত বিকল থাকে। তাই দিনে ১০০-এর বেশি ইঞ্জিন পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ২০২০-২০২১ সালে রেলওয়ে দেড় শ মিটারগেজ কোচ আমদানি করে। তবে নতুন ইঞ্জিন ও কোচ যুক্ত হওয়ার পরও এ সময়ে একটি লোকাল ট্রেনও চালু করা যায়নি। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘লোকাল ট্রেনগুলোতে সাধারণত গরিব লোকজন চলাচল করে। উপজেলা কিংবা গ্রামাঞ্চল থেকে শহর-নগরীকে যুক্ত করে এসব ট্রেন। এক সময় গ্রামের মানুষ এসব ট্রেনে করে কর্মস্থলে যাতায়াতের পাশাপাশি তাঁদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য শহরে নিয়ে যেতে পারতেন। ট্রেনগুলো বন্ধ থাকায় গরিব লোকজন সেই সুযোগ থেকে এখন বঞ্চিত। রেলওয়ে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু ট্রেনই যদি বন্ধ থাকে, তাহলে এত প্রকল্প দিয়ে কী হবে?’

ট্রেন বন্ধ থাকার বিষয়ে রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন সমকালকে বলেন, ‘রেলে ইঞ্জিন ও কোচের সংকট রয়েছে। অনেক দিন জোড়াতালি দিয়ে আমরা অনেক ট্রেন চালিয়েছি। কিন্তু এখন অবস্থা এমনই যে, নতুন ইঞ্জিন ও কোচ না পাওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকা ট্রেনগুলো চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।’ তিনি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনগুলোতে সাধারণত গরিব লোকজন চলাফেরা করে স্বীকার করে দাবি করেন, সেজন্য এসব ট্রেন দ্রুত ফের চালু করার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একেবারে লক্কড়ঝক্কড় ইঞ্জিন ও কোচ দিয়ে লোকাল ট্রেনগুলো চালু করা হয়েছিল। এসব ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা এখন আর নেই। পুরোনো অনেক কোচও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই লোকাল ট্রেনগুলো চালু করতে সময় লেগে যেতে পারে।

করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চে সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে চালু হয় কিছু ট্রেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারিতে বিধিনিষেধ পুরোপুরি উঠে গেলে চলাচল শুরু করে ১৪৬টি ট্রেন। কিন্তু ৪২টি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন আর চালু হয়নি।
এক সময় রেলওয়ে পূূর্বাঞ্চলে ১৮৮টি ট্রেন চলাচল করত। এর মধ্যে ৪৮টি আন্তঃনগর ট্রেন। অবশিষ্ট ১৪০টি ট্রেনের মধ্যে ১৬টি পণ্যবাহী ট্রেন এবং ১২৪টি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন। এসব ট্রেনের মধ্যে ৪২টি এখন বন্ধ। এর মধ্যে রয়েছে- ছয়টি মেইল ট্রেন, ১৪টি লোকাল ট্রেন ও ২২টি কমিউটার ট্রেন।

বন্ধ থাকা ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে চলাচলকারী জালালাবাদ এক্সপ্রেস, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস, আখাউড়া-সিলেট রুটে চলাচলকারী কুশিয়ারা এক্সপ্রেস, লাকসাম-চাঁদপুর রুটের চাঁদপুর কমিউটার, লাকসাম-নোয়াখালী রুটের নোয়াখালী কমিউটার, ঢাকা-জয়দেবপুর রুটের কালিয়াকৈর কমিউটার, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটের নারায়ণগঞ্জ কমিউটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটের নাজিরহাট কমিউটার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেন, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটের চারটি লোকাল ট্রেন, ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ রুটে চলাচলকারী দুটি লোকাল ট্রেন, ময়মনসিংহ-ভৈরববাজার রুটের চারটি লোকাল ট্রেন এবং সিলেট-ছাতকবাজার রুটের চারটি লোকাল ট্রেন।