গর্ত ভরাট যন্ত্র দেখতে এমপি বিদেশে

parliament of bangladesh - songsod

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। সড়কের গর্ত মেরামত ও ফাটল ভরাট যন্ত্রের বিষয়ে তাঁর নেই কোনো অভিজ্ঞতা। তবু যন্ত্র পরখ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় উড়াল দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান। তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) কোটায় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য (এমপি)। ওই দুই দেশ থেকে কেনা এসব যন্ত্রের প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন (পিএসআই), অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী মালপত্র দেওয়া হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতেই তাঁর এই সফর। এসব যন্ত্রের যাচাই ও প্রশিক্ষণে অংশ নিতে গত এপ্রিলে তিনি যুক্তরাজ্যও গিয়েছিলেন।

রওশন আরা মান্নানের একান্ত সচিব (পিএস) ইকবাল বিন মতিন এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) মো. রফিকুল ইসলামও তাঁর সফরসঙ্গী। তাঁরা দু’জন রওশনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যেও গিয়েছিলেন।
সরকারি ক্রয় নিয়ম অনুযায়ী, মালপত্র দেশে আনার আগে পরিদর্শন বাধ্যতামূলক। এ কারণে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা পিএসআইয়ের জন্য বিদেশ যান। তবে এসব নিয়ম ভেঙে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রায়ই পিএসআইয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে চাপ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হয় পিএসআইয়ে। পরিদর্শনের নামে হয় বিদেশ ভ্রমণ!

৫৮৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ‘সড়ক নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ যন্ত্র এবং সরঞ্জাম ক্রয়’ প্রকল্পের আওতায় তাঁরা এই সফরে গেছেন। ঠিকাদার সফরের খরচ বহন করছেন। ৪৭২ কোটি টাকার বিদেশি ঋণের এই প্রকল্পের আওতায় কেনা যন্ত্র পরিদর্শনে গত ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার দফা ভারতে যায় চারটি প্রতিনিধি দল। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলীরা এসব পিএসআইয়ে যান।

এর আগে মোটর গার্ডার ও বুলডোজার চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ, বুলডোজারের টায়ার ক্রয় এবং ১২৯টি ৩ টনের ট্রাকের পিএসআইয়ের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, সিস্টেম অ্যানালিস্ট ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার মতো কনিষ্ঠরাও ভারতের হরিয়ানা, কর্ণাটক ও চেন্নাইয়ে সফরে গিয়েছিলেন।

তবে সড়কের গর্ত মেরামত ও ফাটল ভরাট যন্ত্র পরিদর্শনের এই সফর আগের সব নজিরকে হার মানিয়েছে। রওশন আরা মান্নানের নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে গেছে, তাঁদের মধ্যে শুধু রফিকুল ইসলাম যন্ত্র প্রকৌশলী। অন্য দু’জন কীভাবে যন্ত্র দেখার সফরে গেলেন- এমন প্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী সমকালকে বলেন, ‘স্থায়ী কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাজ নজরদারি করে। স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে উনি (রওশন আরা মান্নান) যেতে পারেন।’ এমপি রওশনের পিএস কেন গেলেন- এ প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘ম্যাডামের অনেক বয়স। তাঁর খেদমতের জন্য তো একজন লোক লাগে।’

গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরের সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়। তাতে সওজের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠানের নামেও জিও হয়। তবে প্রধান প্রকৌশলী দাপ্তরিক ব্যস্ততার কারণে সফরে যাননি। সওজ সূত্র জানিয়েছে, গর্ত মেরামত ও ফাটল ভরাট যন্ত্র দেখতে বিদেশ গেলে বিতর্ক হতে পারে আশঙ্কায় যাননি প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার চেয়ে দেশে বসে এক ঘণ্টা কাজ করলে সওজের উন্নতি হয়।’
জিও জারির পর রওশন আরা মান্নান জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে যাচ্ছেন। তবে পিএসআই সফরে তাঁর কী কাজ সে প্রশ্নের উত্তর দেননি। জিও জারির প্রায় দুই মাস পর ১০ নভেম্বর এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পথে উড়াল দেন রওশন আরা। জিও অনুযায়ী, প্রতিনিধি দলটির সফরের সময় ছাড়া আট দিন বিদেশে থাকার কথা। এই সময়ের বেশি তাঁরা থাকতে পারবেন না। তবে গত বুধবার পর্যন্ত তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন। রওশন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে যুক্তরাষ্ট্রের এমএফজি কোম্পানি পরিদর্শনের ছবি দিয়েছেন। পিএসআই-সংক্রান্ত এই একটি ছবিই পাওয়া গেছে তাঁর প্রোফাইলে। বাকিগুলো ভ্রমণের ছবি।

ছবিতে তিনি ছাড়াও রফিকুল ইসলাম ও ইকবাল বিন মতিনও রয়েছেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকায় রফিকুল ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্য জানা যায়নি। তবে গত অক্টোবরে সমকাল তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, এপ্রিলে যুক্তরাজ্য সফরে তিনি, স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও তাঁর পিএস কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ প্রশ্নে তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী সব যন্ত্রাংশ পাঠানো হয়েছে কিনা, সওজের জ্যেষ্ঠতম যন্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে তা নিশ্চিত করেছেন। স্থায়ী কমিটির সভাপতির তাহলে কী কাজ ছিল- প্রশ্নে রফিকুল ইসলাম বলেছেন, তিনি কর্তৃপক্ষ হিসেবে দেখভাল করেছেন।

প্রকল্পের বেশিরভাগ যন্ত্র ভারত থেকে কেনা হচ্ছে। তা দেখতে কনিষ্ঠ প্রকৌশলীরা যাচ্ছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে কেন জ্যেষ্ঠদের যেতে হয়- প্রশ্নের উত্তর দেননি রফিকুল ইসলাম। যুক্তরাজ্য গিয়েছিলেন সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) মো. আমানউল্লাহ। তিনি পুর প্রকৌশলী। যুক্তরাজ্য সফরেও একমাত্র যন্ত্র প্রকৌশলী ছিলেন রফিকুল ইসলাম।

তবে ভারত সফরে যাওয়া দুই প্রকৌশলী বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার সফর দুটি প্রমোদ ভ্রমণ ছাড়া কিছুই নয়। ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্ট রাখতে ঠিকাদার এই সফরের আয়োজন করেন। সফরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সরকারি নয়, ঠিকাদারের টাকায় তাঁরা বিদেশে গেছেন।

তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, এ দাবি ঠিক নয়। কারণ, ঠিকাদার যখন দরপত্রে অংশ নেন, তাতেই পিএসআই ও প্রশিক্ষণের খরচ ধরা থাকে। সফরের খরচ ঠিকাদার চুকালেও বিলের সময়ে তা সরকারের কাছ থেকে নেয়। ঘুরেফিরে বিদেশ ভ্রমণ সরকার মানে জনগণের টাকায়ই হয়।