সাড়ে ৪ বছর পর নালিশের ব্যাখ্যা দিলেন সেই প্রিয়া

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রিয়া সাহা নামে এক নারীর নালিশে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বাংলাদেশ বিষয়ে এমন বক্তব্যকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে তার বিচার চেয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা।

মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ২৭ জন ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। তাদের মধ্যে প্রিয়াও ছিলেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এই প্রিয়া সাহা। এছাড়াও তিনি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্বরত। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন প্রিয়া। রোকেয়া হলে থাকতেন তিনি।

প্রিয়া অভিযোগ করেন- ‘বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু গুম হয়েছে। এমনকি তার নিজের বাড়িতেও আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তার ভিটে-মাটিও দখলে নিয়েছে।’

সাড়ে চার বছর পর সেই অভিযোগ বা নালিশের ব্যাখা দিয়েছেন তিনি। নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে শনিবার ‘হিন্দু মিলনমেলা নিউ ইয়র্ক’ নামে একটি সংগঠন আয়োজিত হিন্দু সমাবেশে ওই অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, একটা কথা বলা খুব দরকার। আপনারা হয়ত অনেকে জানেন না যে, আমি কেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে এই কথাগুলো তুলে ধরেছিলাম। এসব সংগঠন (বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ) থেকে যেমন জেনেছি, নিয়মিত বুঝেছি, আর কেউ যদি মনে করে যে হঠাৎ করে (ট্রাম্পের সাথে) দেখা হয়েছে আর বলেছি, এটা কিন্তু তা নয়।

তিনি আরও বলেন, ওই পরিসংখ্যানগুলো, বিষয়গুলো তো আমার মধ্যে থাকতে হয়েছে, জানতে হয়েছে। আমাকে গুছিয়ে বলতে হয়েছে আমার সামর্থ্য অনুসারে এবং ঠিক ৪৩ সেকেন্ডের মধ্যে আমি অনেকগুলো বিষয় বলে ফেলেছি, যা দিয়ে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে, তোলপাড় করেছে, প্রতিবাদ করেছে।

প্রিয়া সাহা জানান, তিনি ছোটবেলায় দেখেছেন তার পূর্বপুরুষদের অনেক জমি ছিল। এখন পর্যন্ত তিনশ একর সম্পত্তি রয়েছে তার বাপ-দাদাদের, সেই জমি এখন ‘দখল করে খাচ্ছে’ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। আর সেজন্য তিনি রাজনীতির ‘সবচাইতে প্রভাবশালী’ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, একটি গ্রামকে কীভাবে সিস্টেমেটিকভাবে উচ্ছেদ করে তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল আমাদের গ্রাম। ধরেন যখন ফসল হয়, আমরা রাতে ঘুমাতে পারতাম না। সবাই বলে যে আজানের ধ্বনি শুনলে তাদের মন ভালো হয়ে যায়, আর আমি আঁতকে উঠি। কারণ ভোর রাতে তারা গরু ছেড়ে দিত, আজানের পর তারা হয় ফসল কেটে নিয়ে যাবে, নয়ত আক্রমণ করবে।

প্রিয়া বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে হল- তারা আমাদের ঘের থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের বিধবা জেঠিমার গাভীটি জবাই করে খেয়ে পেটের বাছুরটা ভাসিয়ে দেয় নদীতে। তার কোনো বিচার হয়নি। আমাদের অঞ্চলে (পিরোজপুর) বানিয়ারি নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে দুই-তিন বছর পরপরই একজন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই পাড়ায় বৈষ্ণব বাড়ির একটি ছেলেকে মেরে ফেলল। হত্যার পর সুপারি গাছে চারদিকে চার হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় লাশটি। ছেলেটির চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। বৈষ্ণব পাড়ায় দেড় শতাধিক হিন্দু পরিবার ছিল, ওই ছেলেটিকে হত্যার পর ৬ মাসের মধ্যে পুরো বৈষ্ণব পাড়ার সকলে ভারতে চলে গেল। এর তিন বছর পর আরেকজনকে হত্যা করা হয় পাশের পাড়ায়। তারও চোখ উঠিয়ে পুকুরে লাশ চুবায়ে রাখল।

তিনি আরও বলেন, ‘৩ বছর পার হতে না হতেই উত্তর বানিয়ারিতে ঘরে ঢুকে আমার এক কাকাতো ভাইকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করে। এই যে মানুষ হত্যা করে ক্রমান্বয়ে একটি আতঙ্ক তৈরি করে, তার কোনো বিচার হয় না। আমার এক কাজিন ব্রাদার বীরেন বিশ্বাসকে দিনের বেলায় পিটিয়ে হত্যা করল। আপনারা বলবেন মামলা হয়েছে কিনা। প্রতিটির হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই মামলা হয়েছে। আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা মামলা করতে খুব জানে। কিন্তু ওই যে যেই জজ, সেই পুলিশ, সেই উকিল, সরকারি উকিল, ফাইনালি কিছু হয় না।’

প্রিয়া বলেন, ‘বছরের বড় একটি সময় কোর্টে অতিবাহিত করার পরিবর্তে অনেকে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। সবশেষ আমাদের জায়গার ওপর একশ চিংড়ির ঘের আছে। সেগুলো তারা দখল করে নিল। ২০০৪ সালে আমার বাবার জমির ওপর বিশাল ইটের ভাটা করল। কত মামলা-মোকদ্দমা করা হল, কেউ শোনে না।’

২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন প্রিয়া সাহা। হোয়াইট হাউজে ডনাল্ড ট্রাম্পকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন।

ওই কথার ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তার দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দেশে প্রতিবাদও হয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে তখন বলা হয়, “দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই প্রিয়া সাহা এই ধরনের বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ করেছেন।”

আর বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সে সময় বলেন, প্রিয়া সাহা হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য, সংগঠনের নয়।