পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া—ইসিএ) সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আছে পুলিশের সাবেক আইজি ও র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদের ৪১৮ শতাংশ জমি। এর মধ্যে মোহাম্মাদ ওয়াজিউল্লাহ নামে এক ব্যক্তির ২৫০ শতাংশ জমি ও নারকেলবাগান দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে বেনজীরের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়া গ্রামের সব মানুষের যত জমি আছে, তার চেয়ে বেশি জমি একাই কিনেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। দ্বীপের উত্তরপাড়ায় জমি কিনে সীমানাপ্রাচীরও দিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে বেনজীরের জমিটির দেখভাল করছেন মাওলানা আব্দুর রহমান।
জানা গেছে, স্থানীয়রা জমিটি ‘বেনজীর স্যারের জমি’ হিসেবেই চেনেন।
জমির সীমানা রক্ষার জন্য কোরাল পাথর তুলে এনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কংক্রিটের পিলার দিয়ে জমির চারদিকে সীমানা দেওয়া হয়েছে।
বানানো হয়েছে বড় একটি গেট, যা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া—ইসিএ আইন ১৯৯৫, বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ আইন এবং পরিবেশ আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এছাড়া সেন্ট মার্টিনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বীপঘেঁষা এলাকা উত্তরপাড়া গ্রামের মোহাম্মাদ ওয়াজিউল্লাহ নামের এক ব্যক্তির ২৫০ শতাংশ জায়গা দখলের অভিযোগ উঠছে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। ওয়াজিউল্লাহ জমিটি সেন্ট মার্টিন ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মুক্তার আহমদ ও মাহে আলমের কাছ থেকে কিনেছেন। পুরো ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আক্তার কামাল।
স্থানীয় ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, সেন্ট মার্টিনের জিনজিরা দ্বীপ মৌজার ১০৩০ নম্বর খতিয়ানের ১৭৮৬ দাগে ৮.২৫ শতাংশ, একই দাগে ১৪.১৪ শতাংশ, ৪৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ জমি আছে বেনজীরের নিজ নামে। এছাড়া ১৭২৫ দাগে আছে ২২ শতাংশ জমি। জমির নামজারিতে মালিকের নাম দেওয়া হয়েছে হারুনুর রশিদের পুত্র বেনজীর আহমেদ। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার হোল্ডিং নম্বর ১৬৬। তার জমির খতিয়ানের নামজারি ও জমাভাগ মামলা নম্বর ছিল ৩৫৫ (আই)/২০১৪-১৫ এর ১২/২/২০১৫ ইং তারিখের আদেশ মতে অত্র খতিয়ান সৃজন করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়।
জমিটির বিক্রেতা ছিল স্থানীয় মৌলভী আব্দুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা। খতিয়ানটি সত্যায়ন করেছেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার জাহিদ ইকবাল ও উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো মোছাম্মদ মুসা। খতিয়ানটিতে দেখা যায়, বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন মোট জমির পরিমাণ ১ একর ৬৮.২৫ শতাংশ।
টেকনাফ ভূমি অফিসের সাবেক সহকারী তহশিলদার আবদুল জব্বার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়া এলাকায় বেনজীর আহমেদ সাহেবের জমি আছে। এসব জমি তিনি কিনেছেন ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। এর পরেও উনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামেও কিনেছেন বেশকিছু জমি। ’
২০১১ সালে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করা মৌলভী আব্দুর রহমান এলাকায় বেনজীরের খাস লোক হিসেবে পরিচিত। তিনিই ওই এলাকায় বেনজীরের জমিজমা দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলভী আব্দুর রহমান নিজেও ২০১১ সালে তিন একর জায়গা বেনজীর আহমেদের কাছে বিক্রি করেন। বেনজীর এসব জমি প্রতি একর কেনেন মাত্র ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায়, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। জমি কেনার পর বেনজীর আহমেদের নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা ছিল। পরে ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির পর নিজের নামের সেই সাইনবোর্ড খুলে ফেলার নির্দেশ দেন তিনি।
সেন্ট মার্টিনে জমি কেনার সত্যতা নিশ্চিত করেন সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউয়িন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মুজিবুর রহমান। তারা বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের দক্ষিনপাড়া গ্রামে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ সাহেবের মালিকানায় জমি আছে। আগে পুরো জমির চারদিকে বেড়া দেওয়া ছিল, উনার নিজের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল, কিন্তু এখন নেই। তবে জমির পরিমাণ কত তা জানা নেই। ’
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আক্তার কামাল এই প্রতিবেদককে জানান, দ্বীপের উত্তরপাড়ায় একটি নারকেলবাগানসহ এক দাগে ১২০ শতাংশ জায়গা আছে বেনজীর আহমেদের। এটা দেখভালের দায়িত্বে আছেন মৌলভী আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। এ ছাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়ায় ১৭৮৬ দাগে বেনজীর আহমেদের রয়েছে দেড় একর জমি।
ইনানীতে স্ত্রী ও কন্যাদের নামে ৮৭ শতাংশ জমি
বেনজীর আহমেদ র্যাবের ডিজি থাকার সময় কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ইনানী মৌজায় ৮৬.৯৪ শতাংশ জমি কেনেন। কিন্তু চতুর এই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ওই জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করেননি। রেজিস্ট্রি করিয়েছেন শ্যালক মীর্জা মনোয়ার রেজা, স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং তিন কন্যা ফারহীন রিশতা বেনজীর, তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে। এর মধ্যে ছোট মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর জমি রেজিস্ট্রির সময় নাবালক ছিল। এই জমির বিএস খতিয়ান ও বিএস দাগ নম্বর ৪৭৬২, ৩৭৩৯, ৫২৮২, ৭১৮২, ৫৬৯১, ৫২৮১ ও ৭৭৬৬।
তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, জমির দলিলে মীর্জা মনোয়ার রেজা ও জীশান মীর্জার পিতা মীর্জা মনসুর-আল-হকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি বেনজীর আহমেদের শ্বশুর। দুইজনেরই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে শেখপাড়া, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ফরিদাবাদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এছাড়া ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে বেনজীর আহমেদ। বেনজীর আহমেদের পিতা হারুনুর রশিদের তথ্যও ওই দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। দলিলে বেনজীর আহমেদ ও তার তিন কন্যার ঠিকানা দেখানো হয়েছে বৈশাখী রোড, সবুজবাগ, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জ পৌরসভা, গোপালগঞ্জ।
সোনারপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর পরিশোধ রসিদের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, জীশান মীর্জার হোল্ডিং নম্বর ৫৬৯১, জমির শ্রেণি নাল (আবাসিক), দাগ নং ১০৩৯১ ও জমির পরিমাণ ৭.৩৩ শতক। ২০২৩ সালের ২৮ মে এই কর পরিশোধ করা হয়। জীশান মীর্জার নামে একই দিনে আরও ১৮ শতক জমির ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়া হয়। ২ নম্বর রেজিস্টার অনুযায়ী জমিটির হোল্ডিং নম্বর ৫২৭১ ও দাগ নং ১০৩৮৯।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ মে ফারহীন রিসতা বিনতে বেনজীরের ভূমি করও সোনারপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমা করা হয়। ২ নম্বর রেজিস্টার অনুযায়ী জমিটির হোল্ডিং নম্বর ৭৭৬৬, দাগ নং ১০৩৯১, ১০৩৮৯। এখানে জমির পরিমাণ ৩.৫, ৬.৫ ও ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫ শতাংশ। একই দিনে মীর্জা মনোয়ার রেজাসহ অন্যদের ভূমি উন্নয়ন করও পরিশোধ করা হয়। তবে ২০২৩ সালের ২৯ মে উখিয়া উপজেলার ইনানী-২ মৌজার এই জমি গাজীপুর সদরের নলজানি, চান্দনার বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে স্ত্রীর নামে ৭০ শতাংশ জমি
কক্সবাজারের উখিয়া থানার মেরিন ড্রাইভের পাশে এলজিইডি ভবন সংলগ্ন ইনানী মৌজায় বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে আছে ৭০ শতাংশ জমি। জমিটি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন জালিয়াপালং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিন মেম্বার। জমিটি কেনা হয় ২০০৬ সালে।
কক্সবাজারের উখিয়া থানার জালিয়া পালং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শামসুল আলম নিশ্চিত করে বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভের পাশে এলজিইডি ভবনের কাছাকাছি ইনানী মৌজায় বেনজীর আহমেদ সাহেবের ৭০ শতাংশ জমি আছে। এই জমিটি কিনে দেন আমার ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য নাজিম উদ্দিন ও একই এলাকার সোনারপাড়ার মৌলভী আবুল বাশাক। বর্তমানে তারাই দুইজন এই জমি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন।