যশোরে জাবির হোটেল ট্রাজেডি: ১৬ তলা ভবন ভস্মিভূত, নিহত ২৪

গত সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবরে আনন্দ উল্লাস ও বিজয় মিছিলে যশোরের রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এদিন বিকালে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উল্লাসের মধ্যে নেমে আসে আরেক শোকের ছায়া। সোমবার বিকে সাড় ৪টার দিকে বিক্ষুব্ধ দূর্বৃতত্তরা আগুন দেয় যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ১৬ তলা ভবনে। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উল্লাস শোকে পরিণত হয়ে যায়। দীর্ঘ ১২ ঘন্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে গোটা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। রাতভর দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে থাকে এ বহুতল ভবন। রাতভর চলে উদ্ধার অভিযান। অনেককে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও এ মর্মান্তিক ট্রাজেডিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয় ২৪ জন। এর মধ্যে একজন ছিলেন বিদেশী নাগরিক। আহত হয় প্রায় শতাধিক। শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা যশোর জুড়ে।

শ্বাসরুদ্ধকর এ অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযানসহ সকল বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন যশোর ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক সোহেল রানা।

তিনি জানান, বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে শহরের জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ১৬ তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের খবর পায় যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এরপর ফায়ার স্টেশন থেকে উদ্ধারকারী যান বের করার সময় ফায়ার স্টেশনের মূল ফটকে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়ে একদল দূর্বৃত্ত বাঁধা প্রদান করে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ওই দূর্বৃত্তরা ফায়ার স্টেশনের সামনে থেকে পালিয়ে যান। গোটা সড়কে বিজয় উল্লাসে মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ ছিল। এ সময় শিক্ষার্থীরাসহ বিভি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সেচ্ছাসেবকরা ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক যান চালচলের রাস্তা ফাঁকা করে দেন। এ সময় তারাও ফায়ার সার্ভিসের সাথে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। এর মধ্যে খুলনা ফায়ার সার্ভিসের হেলিকপ্টার এসে জাবির হোটেলের সাদ থেকে একজনকে উদ্ধার করে। বাকিদের পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের সিড়ি দিয়ে উদ্ধার কাজ চালায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলে শুরু হয় লাশের মিছিল। একে একে যশোর জেনারেল হাসপাতালে জড়ো হয় ২৪টি মরদেহ। একশোর বেশি আহতকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে, পরবর্তীতে হাসপাতাল কতৃপক্ষ তাদের শারীরিক অবস্থা দেখে অন্যত্র রেফার করেন।

আগুনের সুত্রপাতের ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, জাবির হোটেলের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে সেটি সেই মুহুর্তে অকেজো হয়ে পড়ে। আগুনটি সিড়ি এবং লিফট দিয়ে ধীরে ধীরে উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ভবনের প্রত্যােক মেঝেতে ফোমের আসবাপত্র ও কাঠের ডেকোরেশন থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ রুপ নিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়।

তিনি বলেনো, ‘আমরা দেখেছি অনেক লাশ আলমারির মধ্যে পোড়া অবস্থায় রয়েছে।কেউ ওয়াশরুমে, কেউবা বেড রুমেই পুড়ে মারা গেছে। যারা পুড়ে মারা গেছে তাদের পোশাক-আশাক দেখে কাউকে কর্মী এবং কাউকে কাস্টমার মনে হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সোহেল রানা জানান, ২৪টি মরদেহের মধ্যে একজন ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক। আমরা তার ব্যাগের মধ্যে থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবং মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের টিকিট পেয়েছি। টিকিটে ওই নিহত বিদেশি নাগরিকের নাম মিস্টার উতম ডিজোকো বলে জানা গেছে।

বাকি নিহতদের মধ্যে হাসপাতাল সুত্রে যেসব নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- সদরের ফতেপুর দাইতলা গ্রামের শওকত আলী ছেলে সেজান হোসেন (২১), খড়কি এলাকার রাসেলের পুত্র রুহান (১৬), উপশহর বি-ব্লক এলাকায় সৈয়দ শাহিন ফরহাদের মিথুন মোর্শেদ পিয়াল (১৮), যশোর জিলা স্কুলের ১০ শ্রেণির ছাত্র রেলগেট ডালমিল এলাকার আবু সাঈদের পুত্র মাহিন (১৬), সদর উপজেলার শাখারীগাতি গ্রামের সাইদুল ইসলামের পুত্র সিফাত (২২), ঘুরুলিয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের পুত্র সোহাবুর রহমান (৩০), শহরের বারান্দি মোল্যাপাড়ার আব্দুল খালেকের পুত্র হাফিজ উদ্দিন (৩৫), সদর উপজেলার বালিয়া ভেকুটিয়া গ্রামের ও জাহাঙ্গীর হোসেনের পুত্র রোকনুজ্জামান রাকিব (২০), হাসপাতালের সার্জারী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চয়ন নামে একজনের মৃত্যু হয়। বাকি নিহতদের নাম পরিচয় এখনো মেলেনি।

এদিকে উদ্ধার কাজের সময় যশোর ফায়ার স্টেশনের কর্মী জিয়ার হাসান অপু নামে একজন আহত হন। পরে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন।

যশোর জেনারেল হাসপাতালে তত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, বিদেশী ওই নাগরিক একজন বাইয়ার বলে জানতে পেরেছি। তিনি বিদেশী পন্য কেনাবেচা করতে বা ঘুরতে এসে ওই হোটেলে উঠেছিলেন। তার ব্যবসায়ীক কাজে জড়িত সাখাওয়াত নামে এক ব্যাক্তি তার মরদেহ হাসপাতাল থেকে লিখিত দিয়ে নিয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি, মরদেহ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের মর্গে এখনো দুজনের মরদেহ রয়েছে যাদের পরিচয় এখনো সনাক্ত হয়নি। গতকাল এমন দূর্ঘটনায় পুলিশের কোন সদস্য হাসপাতালে আসেনি। তারা সুরাহতাল না করায়, যে যার মতো স্বরজনরা লিখিত দিয়ে লাশ নিয়ে গেছে।

এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের সমন্বয়ক রাশেদ খান জানান, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজ না। আমাদের মিছিলের পিছু নিয়ে কিছু সন্ত্রাসী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এমন ন্যাকারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এবং এ ঘটনার সাথে যারা জড়িড তাদেরকে দ্রুড আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি আমরা ছাত্র সমাজ