ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) যেকোনো দাবি আদায়ের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। হঠাৎ যেকোনো ধরনের সংকট, তাৎক্ষণিক দুয়েকটি বাস প্রয়োজন, কোনো ঘটনার বিচার দাবি অথবা বিভাগে পরীক্ষা নিতে দেরি হওয়া-এমন বিভিন্ন ঠুনকো অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক আটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রত্যাশী কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন যার প্রয়োজন দাবি আদায়ে আটকে দেন প্রধান ফটক। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলছে এ অপসংস্কৃতি। পরিবহণনির্ভর ক্যাম্পাস হওয়ায় এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, দুপুর ২টায় এবং বিকাল ৪টায় দুই শিফটে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহনকারী গাড়িগুলো ছেড়ে যায়। দাবি আদায়ের জন্য যেকোনো একটি শিফটের গাড়ি আটকে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তা অনেক সময় দীর্ঘায়িত হয়েছে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। আন্দোলনকারীদের দাবি আদায় হোক কিংবা না হোক, রীতিমতো ভোগান্তির শিকার হন সারা দিনের ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে ফেরা দুই সহস্রাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি অতিথিরা এসেও এমন ভোগান্তিতে পড়ার নজির রয়েছে। টিউশন করে মাসের খরচ চালানো শিক্ষার্থীদের অনেকে সময়মতো টিউশনে যেতে না পারায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার কথা জানান। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিব্রত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিম্মি করে দাবি আদায়ের এই পন্থা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা।
জানা যায়, অভ্যুত্থান পরবর্তী ক্যাম্পাস খোলার পর ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত আট সপ্তাহে চার বার ফটক আটকানোর ঘটনা ঘটেছে। এর আগে গত এক বছরে অন্তত ১২ বার এবং গত পাঁচ বছরে শতাধিক বার প্রধান ফটক আটকে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ২৪ নভেম্বর বিভাগের নাম পরিবর্তনের দাবিতে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করে জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এর আগে ৭ অক্টোবর বিভাগীয় এক শিক্ষকের অব্যাহতির দাবিতে প্রধান ফটক আটকে দেয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরদিন ৮ অক্টোবর তুচ্ছ ঘটনায় মারামারিতে জড়ানো দুপক্ষ একে অপরের বিচার দাবিতে একই দিনে দুবার পর্যায়ক্রমে দুপুর ২টা ও বিকাল ৪টার শিফটের গাড়ি আটকে প্রধান ফটকে মানববন্ধন করেন।
এছাড়া গত বছরের ২৫ নভেম্বর বিভাগীয় পরীক্ষা গ্রহণে বিলম্ব হওয়ায় প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর র্যাগিংয়ের দায়ে পাঁচ ছাত্রকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে অভিযুক্তের সহপাঠীরা, ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালের ট্রিপে অতিরিক্ত বাস বরাদ্দের দাবিতে ফটক আটকায় শিক্ষার্থীরা। ওই বছরেই খেলা সংক্রান্ত দাবিতে শিক্ষার্থীরা ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ২৫ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩ দিনে ৬ বার ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করেন। এছাড়া দুর্ঘটনায় পড়া ছাত্রলীগ কর্মীর চিকিৎসা ও ক্ষতিগ্রস্ত বাইক মেরামতের অর্থ প্রদান, হল প্রভোস্টের পদত্যাগসহ ছোট খাটো নানা দাবি তুলে কয়েক দফায় ফটকে তালা দেয় নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এছাড়াও বিগত সময়ে চাকরি ও চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে সুযোগ পেলেই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মদদে একাধিকবার ফটকে তালা দিয়ে আন্দোলন করা সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের রুটিনে পরিণত হয়।
শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো উচিত। কিন্তু সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার কারও নেই। সবার এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মামুনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গেট আটকানো অমানবিক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আবেদন-নিবেদনে দাবি মানে না। গেট আটকালে মাঝেমধ্যে কিছু দাবি আদায় হয়। ফলে গেট আটকানোকেই একমাত্র পদ্ধতি হিসাবে বেছে নেয় আন্দোলনকারীরা।
এদিকে শিক্ষক সমিতির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হওয়া রেজুলেশন অনুযায়ী ‘বিনা কারণে শিক্ষকদের গাড়ি আটকালে পরদিন কর্মবিরতি পালিত হবে’ এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও তার প্রতিফলন না ঘটায় এ অপসংস্কৃতি বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন শিক্ষক নেতারা। শিক্ষকদের মতানৈক্যের কারণে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণ প্রশাসক অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, যেকোনো মূল্যে এ বাজে সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। ছাত্রদের আরও সহনশীল হয়ে ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করলে এ অপসংস্কৃতি দূর হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরিয়াল বডিকে সব ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের পরামর্শ নিয়ে এর সমাধানে কাজ করতে বলেছি। আমরা এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসব। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে আমরা প্রতিটি অনুষদে গিয়ে কাউন্সেলিংয়ের চেষ্টা করছি। শিক্ষকদের বলব, শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন হোক।