খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে বদলী বাণিজ্যসহ বিস্তর অভিযোগ

খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে বদলী বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে । লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি গুদামে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়ন করে চলেছেন । দারোয়ান এবং পিয়ন বদলীতেও নেয়া হচ্ছে টাকা । খাদ্য সচিব ও ডিজি’র সুপারিশ উপেক্ষা করে তার অফিসে চলছে ওপেন ঘুষ বাণিজ্য । ধান চাল সংগ্রহে কমিশন ও হত দরিদ্রদের ওএমএস এর আটায় ভাগ বসাচ্ছেন আওয়ামী সরকারের দোসর এই অসাধু কর্মকর্তা।

ইতিমধ্যে তার দুনীর্তি ও অনিয়মের সঠিক তদন্ত করে শাস্তির দাবীতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগে ৭২ টি খাদ্য গুদাম আছে । গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই খাদ্য বিভাগের সবচেয়ে লোভনীয় পদ। ওই পদে পোষ্টিং পেতে মরিয়া খাদ্য পরিদর্শক ও উপ খাদ্য পরিদর্শকরা । আর এতে পোয়া বারো অবস্থা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরীর। তিনি রীতিমতো গুদামের আয়তন ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী রেট ভেদে ঘুষ আদায় করছেন । গুদামে পোষ্টিং দিয়ে সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে শুরু করে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করছেন। এতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে । যে কোন সময় সুবিধা বঞ্চিত কর্মকর্তারা কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।

সুত্র বলছে, অর্থের বিনিময়ে গুদামে পদায়ন পাওয়া খাদ্য কর্মকর্তারা গুদামে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই উৎকোচের টাকা উসুল করতে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র গুদামের ওসিএলএসডি পদে বদলীতে অর্থ বাণিজ্য নয়, দারোয়ান এবং পিয়নদের বদলীর ক্ষেত্রেও ঘুষ নিচ্ছেন মি, ইকবাল বাহার চৌধুরী।

নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, গত ৯ মাসে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার ঠৌধুরী শতাধিক কর্মচারী কর্মকর্তাদের বদলী করেছেন । এর মধ্যে প্রায় ৩৫ টি গুদামে ইনচার্জ পদে নীতিমালা বিরোধী বদলীর পদায়ন করে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন । সরকারি চাকরিতে একই কর্মস্থলে ৩ বছর থাকার নিয়ম থাকলেও আরসিফুড মাত্রাতিরিক্ত ঘুষ বাণিজ্যের কারণে দুই বছরের বেশি কোন কোন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুদামে থাকতে পারছেন না । দুই বছর পূর্ণ হলেই সেখানে পদায়ন দেয়া হচ্ছে নতুন ইনচার্জ । খাদ্য সচিব অথবা ডিজি’র সুপারিশ থাকলেও তার অফিসে গুদাম প্রত্যাশীদের ডেকে নিয়ে জোর করে টাকা নেয়া হচ্ছে । তবে সুপারিশ প্রাপ্তদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম টাকা নেয়া হচ্ছে। আগাম টাকা না দিলে বা ধার্যকৃত রেটের কম দিলে বদলীর আদেশে স্বাক্ষর করে আটকে রাখা হচ্ছে । ঘুষের টাকা পরিশোধের পরেই অর্ডারের কপি হাতে দেয়া হচ্ছে । তার অধীনে চাকরি করতে হবে বিধায় অনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন গুদাম প্রত্যশীরা ।

সুত্র বলছে, সম্প্রতি খাদ্য পরিদর্শক মিলন কুমারকে ভেড়ামারা গুদামে পদায়ন দিয়ে ৫ লাখ, সাবিনা ইয়াসমিনকে রুপদিয়া খাদ্য গুদামে পদায়ন করে ৫ লাখ, কার্তিক দেবনাথকে কালীগঞ্জ খাদ্য গুদামে পদায়ন করে ১০ লাখ, কামরুজ্জামানকে কুমারখালী খাদ্যগুদামে বদলী করে ১২ লাখ , নূরে আলম সিদ্দিকীকে শৈলকূপা গুদামে পদায়ন করে ১৫ লাখ, সাব্বির হোসেনকে মহেশপুর গুদামে পদায়ন করে ৮ লাখ, হুমায়ুন কবিরকে হরিণাকুণ্ড গুদামে বদলী করে ৫ লাখ, আব্দুল আলীমকে আলমডাঙ্গা গুদামে বদলী করে ১০ লাখ, গৌরাম্ভা গুদামে আব্দুর রাজ্জাককে পদায়ন করে ৫ লাখ, রামপাল গুদামে গোবিন্দ প্রামানিককে পদায়ন করে ৫ লাখ , মংলা গুদামে আশরাফকে পদায়ন করে ১০ লাখ , নড়াইল সদর খাদ্য গুদামে আহসান হাবীবকে পদায়ন করে ১৫ লাখ, চিতলমারী গুদামে ৫ লাখ, খোকসা ৫ লাখ, আশাশুনি ৫ লাখ, চৌগাছা ১০ লাখ, মোড়লগঞ্জ ১০ লাখ , কালিয়া ৮ লাখ, আলাইপুর ১৭ লাখ , ফকিরহাট ১২ লাখ, বাগ আচড়া ৬ লাখ, বসন্তপুর ৬ লাখ, মনিরামপুর ১৫ লাখ , ঝিনাইদহ সদর গুদামে জাহাঙ্গীর আলমকে পদায়ন করে ৩৫ লাখ টাকা, আড়পাড়া খাদ্য গুদামে কাজল ঘোষকে পদায়ন করে ৮ লাখ, মহম্মদপুর খাদ্য গুদামে কনক কুমারকে পদায়ন করে ৫ লাখ, সপ্না রাণীকে বিনোদনপুর খাদ্য গুদামে পদায়ন দিয়ে ৫ লাখ, আলমগীর হোসেনকে পাইকগাছা গুদামে পদায়ন করে ১২ লাখ, কুষ্টিয়ার সদর খাদ্য গুদামে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পদায়ন করে ২৫ লাখ টাকা ও কুষ্টিয়ার জগতি গুদামে মঞ্জুরুল আলমেক পদায়ন দিয়ে ২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী ।

সুত্র বলছে, বদলী সংক্রান্ত আলোচনা ও টাকা গ্রহণের জন্য আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার ঠৌধুরী তার অফিসের সময়সূচি পরিবর্তন করেছেন । দুপুর ২টা থেকে রাত ১০ পযন্ত অফিস করছেন। বর্তমান যশোর সদর, সাতক্ষীরা সদর, বাগেরহাট সদর,পাটকেলঘাটা খাদ্য গুদামসহ আর প্রায় ৭|৮ টি গুদামের ওসিএলএসডি দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে । ওই গুদামগুলোতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়নের জন্য আগ্রহীদের সন্ধ্যার পর তার অফিসে ডেকে নিয়ে উৎকোচের দর কষাকষি করছেন। এজন্য সন্ধ্যার পর আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তার অফিসে ওসিএলএসডি দের ভিড় লেগে আছে ।

তবে লোক জানাজানি হওয়ায় বেশ কিছু দিন যাবত বদলী প্রত্যাশী পরিদর্শকদের সাথে টাকা নিয়ে দরদামের নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন আরসিফুড । প্রথমে গুদামে বদলী প্রত্যাশী প্রার্থীকে আর সি ফুড অফিসের বড় বাবু শাহিন ডেকে নেন। এরপর দু চার ঘন্টা চলে বড় বাবু শাহিনের দেন দরবার। অর্থাৎ বদলী স্যারকে দিয়ে করায় দেবো আমাকে কত দিবেন? বড় বাবু শাহিনকে বদলী বাবদ এক লাখ টাকা না দিলে আরসিফুডের সাথে দেখা মেলে না । এভাবে গুদাম প্রত্যাশীদের সাথে রফাদফা শেষ হলে তখন তাকে নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বড় বাবু ঘুরে সময় ক্ষেপন করেন। ওই ক্যান্ডিডেটের সাথে কোনো সাংবাদিক বা দুদকের লোক এনেছে কিনা এটা বড় বাবু শাহিন যখন নিশ্চিত হন, তখন তাকে নেয়া হয় নিরালায় আর সি ফুডের বাসার নিচে। সাথে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। তখন সংকেত পেয়ে ইকবাল বাহার ঠৌধুরী উপর থেকে নিচে নামেন। এরপর বড় বাবু, ইকবাল বাহার ঠৌধুরী আর বদলী প্রত্যাশী লেকের পাড়ে হাঁটতে থাকেন আর দরকষাকষি করতে থাকেন। এভাবে একি স্টেশনে একি কায়দায় তিন চার জন প্রার্থীকে ডেকে চলে দরদাম। যার দর সর্বোচ্চ তাকে গুদামে পদায়ন করা হয়। হয় টাকা লেনদেন।

সুত্র বলছে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী । তিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে আরসিফুড হিসাবে খুলনাতে যোগদান করেন। দুইজন সিনিয়র অতিরিক্ত পরিচালক মঈনুল ইসলাম ও নকীব সাদ সাইফুল ইসলামের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কোটি টাকার বিনিময়ে তৎকালীন খাদ্য মন্ত্রী সাধন কুমার মজুমদারের জামাই মাগুরার সাবেক জেলা প্রশাসক নাসির বেগ এর মাধ্যমে আরসিফুডের পদ বাগিয়ে নেন ইকবাল বাহার চৌধুরী । পদোন্নতি পেয়েই ছুটছেন অনৈতিক অর্থের পিছনে। বিগত বোরো সংগ্রহ মৌসুমে ইকবাল বাহার ঠৌধুরী খুলনা বিভাগের ৭২টি এলএসডির থেকে ৭৪৩৩৫,০০০ মেট্রিক চালের কমিশন হিসাবে কেজি প্রতি ১০ পয়সা হারে ৭৫ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন।
ধান ক্রাসিং এ প্রতি ৮০ টন ধান ক্রাসিং বাবদ নিয়েছেন ১০ হাজার করে টাকা। ওই সময় শুধু ধান ক্রাসিং বাবদ ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সদ্য শেষ হওয়া আমন সংগ্রহ মৌসুমে সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে চালের দাম অনেক বেশি ছিল। তারপরও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের খায়েশ পূরণ করতে গুদামের ওসিএলএসডিরা কেজি প্রতি ১৫ পয়সা মিলারদের কাছ থেকে হিস্যা তুলে দিয়েছেন। গুদামের ওসিএলএসডি’রা আদায়কৃত অর্থ নিয়ে সন্ধ্যার পর আরসিফুডের অফিসে পৌঁছায়ে দেন। এজন্য
আরসিফুড অফিসে ডিসি ফুড টিসিএফ ও অন্যান্য কর্মচারীদের আনাগোনা না থাকলেও ওসিএলএসডিদের ভিড় লেগে আছে ।

সুত্র বলছে, আরসিফুড ডিআরটিসি ও সিআরটিসি’র টেন্ডার না দেওয়ার সত্বে পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সাহায্যে মহানগরে বরাদ্দকৃত ৭৬০ মেট্রিক টন গমের ডিও বাবদ কেজি প্রতি ২ টাকা হারে মাসে ১৫ লাখ টাকা আদায় করছেন। এছাড়া ৩২ জন ডিলার থেকে দৈনিক ৩২ হাজার টাকা কমিশন নিচ্ছেন । এই আটা বিক্রির খাত থেকে গড়ে আরসিফুডের মাসিক আয় ২৫ লাখ টাকা। ফলে সরকারিভাবে হতদরিদ্র মানুষের জন্যে বিক্রি করা আটা’ ছিন্নমূল মানুষ না পেলেও আরসিফুডের পোয়াবারো। আরসিফুডের খায়েশ পূরণ করতে ডিলাররা হত দরিদ্র মানুষের কাছে আটা বিক্রি না করে কালোবাজারে বিক্রি করছেন।
সুত্র বলছে, গত ছয় মাস যাবত খুলনা সিএসডিতে ২৩০০০ মেট্রিক টন গম মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে । কিন্তু আরসিফুড মহেশ্বরপাশার সিএসডি ম্যানেজারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সকল গমের চলাচলসুচী মহেশ্বর পাশা থেকে করে দিচ্ছেন। এতে সিএসডিতে জমা থাকা ২৩০০০ মেট্রিক গম নষ্ট হয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ।

সুত্র বলছে , ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসাবে তার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দেলনের নেতারা আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা করেছে। যা তদন্তনাধীন। ইকবাল বাহার ঠৌধুরী পাবনা ডিসি ফুড থাকাকালীন দুর্নীতির কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ায় আগেই তাকে প্রত্যাহার করা হয় । তিনি জয়পুরহাটে ডিসি ফুড থাকাকালীন প্রশাসনিক কারণে সেখানে থেকেও তাকে প্রত্যাহার করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার ডিসিফুড থাকাকালীন মুক্তাগাছা ওসি এল এসডি’র সাথে মিলে ইকবাল বাহার ঠৌধুরী ৩ শ’ টন চাল আত্মসাত করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে দুনীর্তি দমন কমিশন অভিযান চালায়। ওই সময় তার নামে মামলা দায়ের করে দুনীর্তি দমন কমিশন। সে মামলা এখনো চলমান রয়েছে।

ইতিমধ্যে আরসিফুডের লাগামহীন ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে বৈষম্যের শিকার খুলনা খাদ্য পরিবারের সদস্যরা । ওই অভিযোগের অনুলিপি খাদ্য উপদেষ্টা, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, দুনীর্তি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, এনএসআই, ডিজিএফআই সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক দফতরে পাঠানো হয়েছে । অভিযোগের ব্যাপারে জানতে খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসিফুড) ইকবাল বাহার ঠৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি । পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া মেলেনি ।