প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। লন্ডনের সেন্ট্রাল এলাকার ডরচেস্টার হোটেলে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফররত অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের এই বৈঠককে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে চলমান টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক ঘিরে দেশ-বিদেশে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা ও প্রত্যাশা। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই বৈঠক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠকটিকে রীতিমতো টার্নিং পয়েন্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর সঙ্গে তিনি কতগুলো বিশেষণ যুক্ত করে মঙ্গলবার (১১ জুন) সাংবাদিকদের বলেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হতে পারে। সমাধান হয়ে যেতে পারে বিদ্যমান অনেক সমস্যার।
এদিকে আজ (১২ জুন) নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বৈঠক আগামী জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচন-সংস্কার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
রিজভী আরও বলেন, শেখ হাসিনা দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন। তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের মতো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংলাপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সাবেক মন্ত্রী ও ১২ দলীয় জোটের প্রধান জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের দিনক্ষণের ধোঁয়াশা কেটে যাবে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে পতিত স্বৈরশাসকের উসকানি এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, আশা করছি এই বৈঠকের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন গেছেন। উনি সময় করতে পেরেছেন, তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তা না জানা পর্যন্ত মন্তব্য করতে পারছি না। তবে দেশ একটা সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং এই দুই ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আলোচনায় একটা পজিটিভ কিছু আসবে এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আশা করছি একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে। এখানে যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপি এবং আমরা সমর্থন করে আসছি, সেই সমর্থনের কথাটা যখন আলোচনা হবে। আবার এখন যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন, বিশেষ করে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সরকার তো রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তত বেশি বিবেচনার মধ্যে নেয়নি। আমার ধারণা এটা নিয়ে নিশ্চয়ই বৈঠকে আলাপ-আলোচনা হবে। এপ্রিল মাস কোনোভাবেই নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়, এটা যে কোনো মানুষ জানে এবং বোঝে। সেদিক থেকে নির্বাচনটা ডিসেম্বর বা ডিসেম্বরের কাছাকাছি কীভাবে এগিয়ে আনা সম্ভব সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত। আমার মনে হয়, নিশ্চয় আলোচনা হবে।
লন্ডন সফররত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সে দেশে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হওয়ার বিষয়টিকে একটি গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ বলে মনে করে জুলাই বিপ্লবের পটভূমিতে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বুধবার (১১ জুন) বলেন, ‘আমরা একে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। যে কোনো দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনা হতেই পারে। এটি গণতান্ত্রিক চর্চারই অংশ। তবে এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে যেন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নতুন করে বাড়তি চাপ তৈরি না হয়। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে উভয়ের মধ্যে যে আলোচনা হবে সেটা যেন শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বিচার এবং সংস্কারের বিষয়টি যেন সমান গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মধ্যে আলোচনা হওয়া খবুই জরুরি। বিএনপি অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার। তার প্রধান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক কিংবা তিনি (তারেক রহমান) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এটা ইতিবাচক ঘটনা। আমরা আশা করি, রাজনৈতিকভাবে নানা দিক থেকে আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। সেটার অগ্রগতি হবে।’
এ প্রসঙ্গে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বর্তমান সময়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও অযথা বিভেদে দেশের কোনো কল্যাণ নেই। বাংলাদেশের যে কোনো অকল্যাণে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয় সীমান্তের ওপারের আগ্রাসী শক্তি ও তাদের আশ্রিত পলাতক-পরাজিত স্বৈরাচার। তাই এবি পার্টি সব সময় সমঝোতা ও স্যাক্রিফাইসের কথা বলে এসেছে। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্ভাব্য বৈঠক সফল হোক। দেশের জন্য এ বৈঠক কল্যাণকর বার্তা বয়ে আনুক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
লন্ডনের এই বৈঠকে দলীয় রাজনীতির বিশুদ্ধতা ও সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং তারেক রহমানের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার (১২ জুন) এক বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান দল। তাদের মতামত ও নেতৃত্বের গুরুত্ব থাকা স্বাভাবিক। প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক লন্ডন সফরে বিএনপিপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক ঘিরে সরকারের তৎপরতা, অনুমোদন এবং মিডিয়ায় উচ্চমাত্রার প্রচার রাজনৈতিক অঙ্গনে একক ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অনাকাঙ্ক্ষিত ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গাজী আতাউর রহমান বলেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ও। প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের আচরণে ওই ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গাজী আতাউর রহমান আরও বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমভাবে নিরপেক্ষ আচরণ করা হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, ‘বাংলাদেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হচ্ছেন তারেক রহমান। তিনি লন্ডনে আছেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফরে গেছেন। তাদের মধ্যে বৈঠক হতেই পারে। এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসাবেই দেখছি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি এই বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান সংকট সমাধানের ইতিবাচক বার্তা আসবে। ভালো কোনো সিদ্ধান্ত এলে আমরা সেটিকে স্বাগত জানাব।’