বাংলাদেশের জবাবের অপেক্ষায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত

rohingaডেস্ক রিপোর্ট: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে রাখাইনে সংঘটিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের তদন্ত শুরুর অনুরোধ জানিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন জমা হয়েছে। গত বুধবার ৪০০ রোহিঙ্গা নারীর প্রক্ষে তাদের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রটি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে জমা দেন আইনজীবীরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দিন দিন মিয়ানমার বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্র্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইসিসি-ই একমাত্র ভরসা। তবে আইসিসির অবস্থান নিয়েও সংশয়ী আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। একে আরও কার্যকর প্র্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চান তারা।

এমন বাস্তবতায়, নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ প্র্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় রয়েছে আইসিসি। সেখানে থাকা বাংলাদেশি আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ মিয়ানমারের বিচারের দাবি জোরালো করার চেষ্টা করছে বলেও জানানো হয়েছে ওই রিপোর্টে। গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর গণহারে পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা চালায় বর্মীবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে প্র্রাণে বাঁচতে প্র্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গ সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নিপীড়নের শিকার এসব নারীর বেশির ভাগই নিরক্ষর। আদালেতে তাদের আবেদনটির পাশাপাশি আঙুলের ছাপযুক্ত ২০ পৃষ্ঠার একটি বেগুনি রংয়ের নথিও সংযুক্তি হিসেবে দেয়া হয়েছে। একে আবেদনকারী ৪০০ রোহিঙ্গা নারীর স্বাক্ষরপত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আইনজীবীদের দাবি, মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলতেই থাকবে। আইসিসিতে জমা দেয়া আবেদনপত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে অনুরোধ করা হয় যেন আদালত নৃশংসতার বিষয়ে দ্রুত তদন্ত শুরু করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালেতর এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার আছে কি-না? তা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যেই আবেদনটি করা হলো।

আবেদনে বলা হয়, ‘আমরা খুব অসহায় বোধ করছি। আমরা কষ্ট অনুভব করছি। পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে ফেলার শূন্যতা আমরা নিতে পারছি না। আমরা জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার আশা করছি।’

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এতদিন প্রর্যন্ত রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় অপরাধীদের দায়মুক্তি দিতে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইউনিফর্ম পরেই ধর্ষণ ও বেসামরিকদের হত্যা করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকার বিষয়টি ধাক্কা খাওয়ার মতো। তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে যে ধরনের নিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে, একেবারেই সে ধরনের নৃশংসতার বিচার করতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সৃষ্টি। এর ম্যান্ডেট হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার বিচার করা।

প্রসিকিউটর এবং মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবীদরে মতে নিপীড়নের কারণে যেহেতু কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মাধ্যমে এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশ অপরাধ সংঘটনের দায়ে সন্দেহভুক্ত নয়, কিন্তু এ দেশ রোহিঙ্গা নিধনের বিচারের পথ খুলে দিতে পারে। বুধবার শান্তি মহিলা বা পিস উইমেন নামের সংগঠনটির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আবেদন জানানো হয়।

সংগঠনটির আইনজীবীরা বলেন, যতক্ষণ প্রর্যন্ত মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে না বলবে এবং তাদেরকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিবিদ্বেষ, নিপীড়ন ও গণহত্যা চলতে থাকবে। আদালত যদি আবেদনে সাড়া দেয়, তবে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে মৌলিক যাত্রার সূচনা হবে। রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মিয়ানমারের বিচার করতে পারে কিনা গত ৭ মে (সোমবার) সে ব্যাপারে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে রোমভিত্তিক আদালতটি। আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার এক চিঠিতে মিয়ানমারের বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে চেম্বার মনে করে বাংলাদেশের কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত চাওয়াটা সঠিক।’

চিঠিতে মূলত তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত চাওয়া হয়েছে। ১. মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গাদের অবস্থা কী ২. রোহিঙ্গা বিতাড়ন বিষয়ে শুনানির জন্য আইসিসির কোনো অধিকার আছে কিনা এবং ৩. এ সংক্রান্ত অন্য যেকোনো প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কী।

আগামী ৮ই জুনের মধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনীয়ভাবে মতামত জানানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল সে সময় বলেছিলেন- আমরা আইসিসির চিঠি পেয়েছি এবং বিষয়টি বিবেচনা করছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত সপ্তাহে বলেন- আমরা বিষয়টি দেখছি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আইসিসি অপেক্ষায় আছে, এ বিচারের ইস্যুটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কী বলে। ওই সংবাদমাধ্যম বলছে, আইসিসি যেন মিয়ানমারের বিচারের আবেদনের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, তার সমর্থনে বাংলাদেশি স্কলারদের একটি দল তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আইসিসিকে তার অবস্থান জানাবে কি-না? সে বিষয়ে এখনও দ্বিধা রয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিপক্ষীয় সমাধান না-কী মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়ে পুঞ্জীভূত ওই সংকটের টেকসই সমাধান খোঁজা উচিত তা নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল প্র্রতিনিধিদের মধ্যে শুরু থেকেই ভিন্নমত রয়েছে।