মাদক অধিদপ্তরের ঢাকার তালিকায় নেই শীর্ষ ব্যবসায়ী

ডেস্ক রিপোর্ট: চলছে মাদক বিরোধী কঠোর অভিযান। দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা নিয়ে মাঠে বিভিন্ন অভিযানে র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী। পিছিয়ে নেই রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনও(দুদক)।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তিন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি। তবে অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ীদের অনুসন্ধান নিয়ে বিপাকে রয়েছে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার‌্যালয়।

কেননা দুদকের অনুসন্ধান ও সংশ্লিস্ট থানার তথ্যানুসারে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকার ২৩ ব্যক্তির মধ্যে নেই শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির তালিকাভুক্ত অনেক ব্যক্তির নাম ও ঠিকানার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কারো কারো নাগাল পাওয়া গেলেও তাদের অধিকাংশই প্রান্তিক পর্যায়ের মাদকসেবী কিংবা ব্যবসায়ী। যাদের অবৈধ সম্পদ খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ২৩ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন মোটামুটি মাদক ব্যবসায়ী বলে এলাকায় পরিচিতি রয়েছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা থাকা ১১ নম্বর থেকে ২৩ নম্বর পর‌্যন্ত যে সব ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে স্থানীয় থানার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যানুসারে এবং নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে এদের অধিকাংশই সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদকসেবী বলা যায়। যা একেবারে প্রন্তিক পর্যায়ের। মাদকের গডফাদার বলতে যা বুঝায় তা তারা নয়। আর সম্পদের যে তথ্য মেলে তা একেবারেই নগণ্য।

ঢাকা বিভাগের ২৩ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকার মধ্যে ১ ও ২ নম্বরে রয়েছে ঢাকা বিভাগের ময়নসিংহ জেলার হালুয়াহাট থানার মরিয়ম বেগম ওরফে কুট্টি ও একই এলাকার জরিনা। মাদক দ্রব্য অধিদপ্তরে তথ্যানুসারে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বলা হলেও দুদকের অনুসন্ধানে কিংবা ময়মনসিংহের থানা পুলিশের বক্তব্য অনুসারে এলাকা ছেড়ে গেছেন বেশ আগে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করার কথা এলাকাবাসী জানালেও কেউ তাদের ঠিকানা বলতে পারেনি। তাছাড়া এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুসারে এরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়।

অন্যদিকে তালিকা অনুসারে ঢাকা বিভাগের মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা নাদিম ওরফে পঁচিশ। মোহাম্মদপুর থানার দেওয়া তথ্যানুসারে ঠিকানা ও নাম যথাযথ নয়।

তালিকায় থাকা ৪নং ব্যক্তির নাম ঢাকার বংশাল পানির পাম্পের নিকটবর্তীর এলাকার বাসিন্দা মো. কাশেম্। বংশাল থানার তথ্যানুসারে তার বিরুদ্ধ মাদক ও অস্ত্রসহ মোট ১৫টি মামলা রয়েছে। বতর্মানে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দুদক তার বাড়ির ঠিকানায় গত ১২ মার্চ তলবি নোটিশ পাঠালেও দুদকের ডাকে হাজির হননি।

তালিকায় ৫ নম্বর অবস্থানে রয়েছে ঢাকা জুরাইনের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বাপ্পা। দুদকে পাঠানো তার ঠিকানার সত্যতা পাওয়া গেলেও কদমতলী থানা জানিয়েছে বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী নয়। তবে তার নামে থানায় ৩টি অস্ত্র মামলা ও ৩টি মাদক মামলা রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে তার সম্পদের বিষয়ে মোটামুটি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মোট সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে ৩ কাঠা জমির উপর টিনশেড ২টি বাড়ি রয়েছে।

তালিকার ৬ নম্বরে রয়েছে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ার বাসিন্দা শামসুন্নাহার ওরফে শামসুন্নীর নাম। সংশ্লিষ্ট থানার তথ্যানুসারে সে মাদকের খুচরা ব্যবসায়ী। দুদকের অনুসন্ধানে তার নামের ওইভাবে সম্পদ নেই।

তালিকার ৮ নম্বরে আছে ঢাকা বাড্ডার সাতারকুলের মো. আরিফ। বাড্ডা থানার তথ্যানুসারে সেও প্রান্তিক পর্যায়ের মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে থানায় তিনটি মাদক মামলা রয়েছে। নিজ নামে এখনো সম্পদ খুঁজে পায়নি।

ঢাকার বাড্ডার সাতারকুল এলাকার বাসিন্দা মামুন রয়েছে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের তালিকার ৯ নম্বরে। বাড্ডা থানার তথ্যানুসারে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তিনি সাতারকুল এলাকায় মুদি ব্যবসায়ী, থাকেন বাবার বাড়িতে। নিজের নামে কোনো সম্পদ নেই। তবে এক সময় মাদক গ্রহণ করতেন বলে দুদকের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

তালিকার ১১ নম্বরে রয়েছে নারায়নঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ থানার বাগমারার বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়া ওরফে টাইগার সেলিম। যিনি এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী বলে পরিচিত। নারায়নগঞ্জ থানার তথ্যানুসারে তার বিরুদ্ধে ১৪টি মাদকসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন। দুদক থেকে তাকে গত ১৪ মার্চ তলব করে চিঠি দেওয়া হলেও হাজির হননি বলে দুদক সূত্র জানা যায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকার ১, ২ এবং ১০ নম্বরে থাকা ব্যক্তিদের নাম ও ঠিকানা খুঁজে পায়নি সংশ্লিষ্ট থানা। তবে থানার বক্তব্য অনুসারে এরা এক সময়ে এলাকায় বাস করার কথা কেউ কেউ জানালেও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে ১১ থেকে ২৩ নম্বর পর‌্যন্ত তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট থানার বক্তব্য ও দুদকের অনুসন্ধানেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে, তাদের অধিকাংশ ঠিকানা অস্তিত্বহীন, অসঙ্গতিপূর্ণ। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান ও সহকারি জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পৃথক দুইটি টিম এ অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করছেন।

এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন বলেন, মাদক অধিদপ্তরের তালিকা নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলমান। মাদকের ব্যবসার নামে যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের নুন্যতম ছাড়া দেওয়া হবে না।

এদিকে এ পর‌্যন্ত ৭৭ নথিতে তিন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর সম্পদের খোঁজে মাঠে রয়েছে দুদক। ফাইল অনুযায়ী ওইসব অভিযোগ অনুসন্ধানে ঢাকায় ও দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়গুলোতে বিশেষ টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। যাদের তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন দুদকের অন্তত ১০ পরিচালক। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ বিভাগ। মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তালিকায় থাকা রাজধানীর রূপনগরের ৭ নম্বর ঝিলপাড়া বস্তির (চলন্তিকা বস্তি) নজরুল ইসলাম এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।

প্রসঙ্গত, মাদকের বিরুদ্ধে মূলতঃ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করলেও দুদক আইন-২০০৪ এর ২৭ ধারা অনুযায়ী শুধু জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত সম্পত্তির অধিকারী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে অর্থদণ্ড এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধানও রয়েছে।