রাজশাহীর ফাঁকা রাস্তায় সার্কাস

রাজশাহী প্রতিনিধি: জৈষ্ঠের পড়ন্ত বিকেল। রাজশাহী নগরীর পাঠানপাড়া বিদ্যুৎ অফিস মোড়ের প্রশস্থ সড়কের ধার। একদল মানুষ জটলা পাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে কি যেন দেখছে! সময়ের সাথে ভিড়ও বড়ছে। দর্শকদের মধ্যে কিশোর ও যুবকদের সংখ্যাই বেশি। আবার পথচারীদের কেউ কেউ রিক্সা বা মটরসাইকেল থামিয়েও ভিড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। সাথে কিছু মহিলা দর্শকও জুটেছে। জটলা থেকে শিশুদের উল্লাস।

circusকৌতুহল নিয়ে কাছে যেতেই দেখা গেল তিনজন মানুষ ফুটবল, টেনিসবল, থালা, লাঠি নিয়ে নৈপ্যুন্যের সাথে বিভিন্ন ধরণের খেলা প্রদর্শন করছে। আর এই মানুষগুলোকেই বৃত্তাকারে ঘিরে ধরে দাড়িয়ে রয়েছে কৌতুহলীদের দল।

তিনজনের মধ্যে একজন মাঝ বয়সী ও দুজন যুবক। মাঝবয়সী মানুষটির গাল ভর্তি কাচা-পাকা খোঁচা দাড়ি ও ঠোটে বাঁশি। কিছুক্ষণ পর পর স্বাজোড়ে বাঁশি বাজিয়ে চিৎকার করে বলছেন ‘এই যে দেখেন; দেখেন খেলা দেখেন’। বাঁকি দুজন যবুক, পরণে জিন্স, টিসার্ট; সাথে স্টাইলিশ হেয়াকাট। দুজনের মাথায় ফুটবল ও হাতে জাগলিং গেম দেখানোর জন্য তিনটিকরে স্টিক। হাত না লাগিয়েই মাথায় বল নিয়ে দিব্বি হেটে চলেছেন। এখানেই শেষ নয়, সমানতালে হাতে জাগলিং করছেন তিনটি স্টিক দিয়ে। তাই দেখে কৌতুহলী মানুষগুলো করতালী দিয়ে যুবকদেরকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। কিছুক্ষণপর খেলার ধরণে পরিবর্তন আসল। যুবকদ্বয় মাটিতে শুয়ে দুজনের ঘারের ওপর একটি বল নিয়ে তা একবার পায়ের দিকে গড়াচ্ছে, আবার সুনিপূণ দক্ষতায় ঘারের দিকে নিয়ে আসছেন। আবার ব্যলেন্স করে বল ঘারে রেখেই দুই পা মাটি থেকে শুন্যে তুলে ধরে রেখেছেন।

ভিড়ের মধ্যে থাকা মা-বাবারা তাদের কোলের বাচ্ছদের ইশারা দিয়ে সেই খেলাগুলো দেখাচ্ছে। বাচ্চারাও অপলক দৃষ্টিতে তা পর্যবেক্ষণ করছে। আর কিশোরেরা এই খেলা দেখে করোতালি দিয়ে যুবকদ্বয়কে উৎসাহ যোগাচ্ছে। প্রায় আধা ঘন্টা চললো এ ভাবেই।

এরমাঝে একটি বিশাল গামছা বিছিয়ে দেয়া হল সকলের মাঝে। তবে খেলা দেখানো থামেনি। খেলোয়ারেরা সাইড হয়ে খেলা দেখাচ্ছে। ঠোটে বাঁশি নিয়ে মাঝ বয়সী সেই লোকটি স্ব-জোরে বলে উঠলেন, ‘দেন ভাই যে যা পারেন দেন। খেলোয়ারদের খুশি করতে যে যা পারেন দেন।’ তবে এবার ভিড় কমতে শুরু করল। বাঁশি ঠোটে সেই মানুষটি গামছার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার সথে সেই দুই যুবকও হাতের আঙুলে ফুটবল নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে ওই বাঁশিওয়ালার দিকে তাকিয়ে। বিকেল গড়িয়ে সূর্য ডুবতে শুরু করল। আকাশ ফিকে হয়ে এসেছে। এই তিনজনের চেহারাটাও এখন যেন অস্পষ্ট।

ভিড় কমলে ওই বাঁশিওয়ালার কাছে গিয়ে জানা গেল তার নাম আব্দুল লতিফ। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলায়। রাজশাহীতে তিনি তার যৌবনকালে পা রাখেন। এখন তার বসবাস শেখেরচক এলাকয়। পরিবারিক জীবনে তার চার সন্তান। পরিচয়ের একপর্যায়ে জানাগেল, কিশোর বয়স থেকেই আব্দুল সার্কাস পার্টির সাথে জড়িত। একসময় গ্রামবাংলায় ঐতিহ্যবাহী সার্কাসের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও, সময়ের ব্যবধানে এখন সেই সার্কাস ও সার্কাস পার্টি বিলীন হতে চলেছে। তাই এই পাটির সদস্যরা এখন বাধ্য হয়ে ফুটপাতে নেমে পড়েছেন সার্কাস খেলা দেখাতে। কারণ তারা এর বাইরে ওন্য কোন কাজ শেখেনাই।
আব্দুল আরও জানান, দিন শেষে খেলা দেখিয়ে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে দুইশ থেকে তিনশ টাকা থাকে। এ দিয়ে তার সংসার চলান দ্বায়। এখন আর মানুষ ফুটপাতে দাড়িয়ে খেলা দেখতে পছন্দ করে না। দেখলেও টাকা ফেলে না। তার ভাষায় ডুবতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী সার্কাসের সুর্য।