চাল নিয়ে চালবাজি

rice33ডেস্ক রিপোর্ট: খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুত রয়েছে। চলতি বছর বোরো ফসল থেকে ১ কোটি ৯২ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আবার এবার বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে ফসলহানিও হয়নি। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই চালের বাজার অস্থির। অথচ বাজারে এখন যে চাল আছে, সেটি আগেই আমদানি করা। চালে দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে ফের অসন্তুষ্টি বাড়ছে।

কিন্তু কেন বাড়ছে চালের দাম এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না। সবচেয়ে খারাপ খবর যেটি তা হলো মিলার এবং আড়তদাররা খুচরা বিক্রেতাদের বার্তা দিয়ে রেখেছেন ঈদের পর চালের দাম আরো বাড়বে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চাল আমদানিতে শুল্ক আরোপের বিষয়টি। তবে সেই শুল্ক আরোপ বাজেটে প্রস্তাব এসেছে। বাজেট পাস হলে জুলাই মাস থেকে এটি কার্যকর হবে। আর তা হলেও আমদানি করা চাল বাজারে আসতে আরো অনেক সময় লাগবে। এরই মধ্যে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেয়ার পরই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে চাল ব্যবসায়ীদের চালবাজি বলে মনে করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজেটে চালের আমদানি শুল্ক পুনর্বহালের খবরেই বাজারে বেড়ে গেছে চালের দাম। বাজেট ঘোষণার পরই পাইকারি বাজারে আমদানি করা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা। তবে বোরো ধান পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর ধানের দাম বৃদ্ধির কারণ কী, সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি বিক্রেতাদের কাছে।

জানা গেছে, বাজেটে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ পুনর্বহাল করার দুই দিনের মাথায় বাজারে কারসাজি শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে যে চাল মজুত আছে, তার পুরোটাই শূন্য শুল্কের সুযোগ নিয়ে আমদানি করা। গত কয়েক দিনে দেশে নতুন করে চালও আমদানি হয়নি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, বাংলাদেশে চালের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারতে চালের দাম প্রতিদিন কমছে। অন্যান্য দেশেও চালের দাম স্থির আছে। ফলে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

সূত্র জানায়, গত বছর বন্যায় ফসলহানির কারণে আমদানি উৎসাহিত করতে সরকার ২৮ থেকে দুই ধাপে শুল্ক কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। এ সুযোগে বেসরকারি আমদানিকারকরা ব্যাপক চাল আমদানি করেন। এবার বোরো উৎপাদন ভালো হওয়ায় কৃষকরা যাতে ন্যায্য দাম পান, তার জন্য বাজেটে ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকার এবার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ২৬ টাকা। কিন্তু বাজারে ধানের দাম সাত শ থেকে আট শ টাকার মধ্যে। তবে ধানের দর নির্ধারিত দামের চেয়ে কম হলেও চালের দাম নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি। সরকার সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৮ টাকা। অথচ রাজধানীর বাজারে সবচেয়ে কম দামের চালও ৪০ টাকার নিচে মিলছে কম।

এদিকে বাজারে চালের দাম বাড়লেও সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) দৈনিক বাজার দর তালিকা অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে কোনো ধরনের চালের দাম বাড়েনি। তবে গত বছরের তুলনায় এখনও প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চালের কেজি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসে মিনিকেট চাল প্রতি বস্তায় কমেছিল ৫০ টাকা। রমজানের মাঝামাঝি দাম কমলেও বাজেটের দুদিন আগে দাম দাঁড়িয়েছে আগের জায়গায়। প্রতি বস্তা চাল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকায়। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে প্রতি কেজি ভারতীয় মিনিকেট চালের দাম ছিল মানভেদে ৪৫ টাকা। এখন তা বিক্রি হয়েছে ৫০-৫১ টাকায়। প্রতি কেজি ভারতীয় নাজিরশাইল চালের দাম বৃহস্পতিবার ছিল ৫০ টাকা। এখন তা ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মোটা চাল স্বর্ণা ও রত্নার দাম ছিল ৩৫-৩৬ টাকা। একই চাল বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। আর প্রতি কেজি দেশি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৪৮-৫০ টাকা, যা বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকায়।

খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) ১১ মাসে চাল আমদানি হয়েছে ৩৯ লাখ ৬৬ হাজার টন।

দেশের চালকল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী বলেন, শুল্ক বাড়ানোর ফলে ও গত কয়েক দিনে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ধানের আর্দ্রতা কমেছে। এতে শুকনা ধানের দাম প্রতি মণে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। তবে এখনো চালের দাম বাড়ার কথা না। সরকারের উচিত চালের বাজারে তদারকি বাড়ানো।

বাংলাদেশ অটো-মেজর ও হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, এবার দেশে চালের উৎপাদন ভালো আছে। কোনো ঘাটতি নেই। শুল্ক বাড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে চালের বাজারে কারসাজি করতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা কম শুল্কে আমদানি করে আগে মজুদ করা চাল এখন বাজারে ছাড়ছেন। নতুন শুল্কে আমদানি করা চাল আরো পরে আসবে। ফলে বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

এদিকে বাংলাদেশে চাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর কারণে ভারতে রপ্তানি করা চালের দাম কমেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের ঊর্ধ্বমুখী দরও স্থির হয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ছিল বড় আমদানিকারক।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি চালের আমদানি মূল্য ৩৫ টাকা, থাইল্যান্ডে ৪০ ও ভিয়েতনামে ৪১ টাকা। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৩৮ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। আরো ৪৫ লাখ টন চাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ লাখ টনের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে।

গত বছর দেশে তিন দফা বন্যায় চাল উৎপাদন কমে যায়। এতে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে মোটা চালের কেজি আগস্টে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতে সরকার চালের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়। এর ফলে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা প্রচুর চাল আমদানি করে মজুদ করেন। শুধু বেসরকারি খাতে নয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ রয়েছে। চলতি বছর বোরো ফসল থেকে এক কোটি ৯২ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।

চালের ভরা মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও রাজধানীর বৃহৎ কাঁচাবাজার হাতিরপুল, পূর্ব রাজাবাজার ও কারওয়ানবাজারহ কয়েকটি চালের বাজারে প্রতি কেজি চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাল ক্রেতা নুরুন্নাহার অভিযোগ করে বলেন, চালের দাম তো কমার দিকেই ছিল। এখন তো চালের দর বাড়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

হাতিরপুল বাজারে দেখা যায়, ভালো মানের প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা। আটাশ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা। নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে সবচেয়ে চাহিদার চাল স্বর্ণা বা মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকার মধ্যে। এছাড়া দেশে উৎপাদিত নতুন চাল ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

হাতিরপুল বাজারের চাল ব্যবসায়ী ওয়াজিদ মিয়া বলেন, চালের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। ঈদের পরেই চালের কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ার আভাস দেন তিনি। তবে এই মুহূর্তে চালের বাজার অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে স্বীকার করেন এই চাল ব্যবসায়ী।

কাওরানবাজারে সততা ট্রেডিং এ চাল কিনতে এসে হারেছ উদ্দিন বলেন, এই ভরা চালের মৌসুমে চালের দর না কমলে কবে কমবে। যে হারে চালের দাম বেড়েছে সে হারে দাম না কমে আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন এই ক্রেতা। এ বাজারটিতে দেখা যায়, খুচরা অন্যান্য বাজার থেকে ৫ টাকা কমে ভালো মানের মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। পাইজাম, আটাশসহ অন্যান্য নিম্ন মানের মিনিকেট চাল বিক্রি করতে দেখা গেছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা কেজিতে। সূ্ত্র: মানবজমিন