বজ্রপাত প্রতিহত করার উপায়

ডেস্ক রিপোর্ট : এ বছর বৈশাখ শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ আগেই আমরা কালবৈশাখী প্রত্যক্ষ করেছি। গত ৩০ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫টি জেলায় কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে।

এই আগাম কালবৈশাখী অনাকাক্সিক্ষত, একই সঙ্গে অনিয়মিত প্রচুর বৃষ্টি এবং ক্রমবর্ধমান বজ্রপাতের সংখ্যাও অনাকাক্সিক্ষত। এ বছর পৃথিবীব্যাপী বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়েছে।

গত ২৬ মে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে চার ঘণ্টার মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। গত ২৮ মে ভারতের বিহারে ১১ জন, উত্তরপ্রদেশে ১৫ জন, ঝাড়খণ্ডে ১৩ জন বজ্রপাতে মারা গেছে।

যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত বজ্রপাতে আহত বা নিহতের পরিসংখ্যানে তারতম্য রয়েছে, তথাপি বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারে’র দুর্যোগ সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে ৩০ মে ২০১৮ পর্যন্ত বজ্রপাতে ২১১ জন নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু মে মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৪১ জন, যেখানে ৯ মে সর্বাধিক ২৯ জন মারা যান এবং ১৫ জন আহত হন। মোট মৃত্যুর শতকরা ১৯ জন মহিলা এবং শতকরা ৭৭ জন বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজ, মাছ ধরা, গরু চরানো বা ঘাস কর্তনরত অবস্থায় ছিলেন।

আবার কৃষিকাজরত হতভাগাদের শতকরা ৬৩ জনই শুধু ধান ফসলের মাঠে কর্মরত ছিলেন। যা হোক, মৃতের পরিবারগুলো সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাবে বিধায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটিকেই প্রণিধানযোগ্য ধরে নেয়া যেতে পারে, যা তারা নিয়মিত ওয়েবসাইটে আপডেট করছেন।

তবে পরিসংখ্যানগত তারতম্য ব্যতিরেকেও কিছু মৌলিক তথ্যে বিভ্রান্তি লক্ষ করা যাচ্ছে; যেমন, গত ৬ মে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালে বজ্রপাতে প্রায় ৩৫০ জনের মৃত্যুর পর সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বস্তুত, সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে ২০১৬-এর ১৭ মে তারিখে, যার মূল পটভূমি ছিল ১১-১২ মে’তে প্রায় ৫৭ জনের মৃত্যু।

বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো ও প্রাণহানি রোধে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছে বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর, যা চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, ঢাকা, নওগাঁ, সিলেট, পটুয়াখালী ও পঞ্চগড়ে বসানো হয়েছে।

এই সেন্সর থেকে আপাতত পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরই কেবল তা দিয়ে মানুষকে আগাম সতর্কতা জানানো সম্ভব হবে।

অথচ বিএমডি ওয়েদার অ্যাপ ব্যবহার করে অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই সেন্সর থেকে ২৫০ কিলোমিটার পরিধি পর্যন্ত পূর্বাভাসের তথ্য পাওয়া যাবে বলেই আমাদের জানা ছিল, যদিও কুমুলাস বা কুমুলোনিমব্যাস নামের বজ্রমেঘগুলো খুবই অস্থিতিশীল এবং বাতাসের গতিপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে খুব স্বল্পসময়ে তা স্থান পরিবর্তন করতে পারে।

এ ছাড়া সেন্সর দ্বারা কোথায় বজ্রপাত হচ্ছে বা হবে, মেঘ থেকে মাটিতে আঘাত করা বজ্রপাতের সংখ্যা, মেঘের স্ট্যাটিক চার্জ ইত্যাদি জানা সম্ভব। প্রায় ৮ মাস আগেই ১টি বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর ঢাকায় আবহাওয়া অধিদফতরের বসানো হয়েছে কিন্তু তা বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে কতটুকু কাজে এসেছে আমাদের?

জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ, বজ্রপাতের বিষয়ে সতর্কতায় সারা দেশে ২০০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার স্থাপন করা হচ্ছে। অধিকন্তু, বজ্রপাতের পূর্বাভাস পেতে সারা দেশে ৪টি রাডার স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যার একটি বসবে সিলেট বিমানবন্দরে।

এ ছাড়া সিলেটে ১৮টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার বসানো হবে। কিন্তু এগুলো কি শুধু বজ্রপাত পর্যবেক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? প্রসঙ্গক্রমে, ময়মনসিংহের সুতিয়াখালি ইউনিয়নের ২০০ জন কৃষকের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৯৭ শতাংশ কৃষক মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন যাদের প্রায় ৯২ শতাংশেরই ফোন সনাতন প্রযুক্তির অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম নয়।

বাকিদের ফোন এন্ড্রয়েড হলেও তাদের বেশিরভাগই কল ধরা এবং করা ছাড়া অন্য কোনো অ্যাপের ব্যবহার জানেন না। ইন্টারনেট সংযোগ নির্ভর ওয়েদার অ্যাপ ব্যবহার করে হাইটেক সেন্সরের ভাষা বোঝার সেন্স আমাদের দেশের কৃষক-জেলেদের এখনও হয়নি।

তাছাড়া ধানের পরিচর্যা ও ধান কাটার মৌসুমে এবং জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আবহাওয়া যত খারাপই হোক না কেন, পরিবারের উপার্জনক্ষম কৃষক-শ্রমিক-জেলে পরিবারের ব্যক্তিটির মাঠে-জলাভূমি-হাওরে যাওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।

কাজেই বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর প্রকৃত অর্থেই কতটুকু কাজে আসবে আমাদের কৃষক ও জেলে শ্রেণীর মানুষদের মৃত্যুসংখ্যা কমাতে? উপরন্তু, এসব প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি পরিচালনায় যথেষ্ট কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন।

জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সেন্সর থেকে সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে আবহাওয়া অধিদফতরের একটি প্রতিনিধি দল নরওয়ে যাবে এবং সেখান থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে আসবে। এরপর একটি বিশেষজ্ঞ টিম গড়ে উঠবে এবং সেন্সরগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।

এটাই যদি উত্তম হয়, তবে প্রাণহানি কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর সেন্সরগুলো স্থাপন করলে তা হয়তো ব্যবস্থাটি আরও বেশি কার্যকর হতো।

বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্য অনেক নিয়ামকের সঙ্গে বায়ূদূষণ একটি প্রধান কারণ। গত ২ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, সারা বিশ্বে বায়ুদূষণে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকার অবস্থান তৃতীয়।

পরিবেশ অধিদফতরের ‘বায়ুমান মনিটরিং স্টেশন’ এবং ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের পর্যবেক্ষণকৃত উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, গাজীপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি।

ওজোন, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডসগুলোও বায়ুদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৃষ্টিহীন নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মূলত এই দূষণগুলো বেশি ঘটছে। ইটভাটা, গাড়ি ও কলকারখানার ধোঁয়া, ইমারত ও রাস্তা নির্মাণকাজ, পাহাড়ের ঢালে গাছ পুড়িয়ে চাষের জমি তৈরি ইত্যাদি এই দূষণে ভূমিকা রেখে চলেছে।

উল্লেখিত দূষণের সঙ্গে শীতকাল চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরই বজ্রপাত বাড়ার একটি সম্পর্ক আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। বাতাসে দূষণ বাড়ার সঙ্গে মেঘ থেকে ভূমিতে পতনযোগ্য বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পৃথিবীর অনেক দেশেই একটি প্রমাণিত বিষয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গত ১ মে’র প্রেস ব্রিফিংয়ে সারা দেশে প্রায় ৩২ লাখ তালবীজ রোপণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রায় শতফুট উচ্চতার শাখাবিহীন শতবর্ষী উদ্ভিদ তালগাছের অঙ্কুরোদগম হতে প্রথম ৭ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ার গতি অত্যন্ত ক্ষীণ, পরবর্তী ১০ বছরে প্রায় ২০-২২ ফুট বাড়ে এবং তৎপরবর্তীতে প্রতি বছরে প্রায় ১-৩ ইঞ্চি করে বাড়ে।

একবার একটি তালগাছ বজ্রবিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে তার আর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা থাকে না অর্থাৎ সেখানে পুনরায় একটি নতুন গাছ লাগানোর প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় উচ্চতায় বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাসের উপযোগী হতে একটি তালগাছের যত সময় প্রয়োজন হবে ততটা সময়ে, অথবা সেন্সর বা রাডার পূর্বাভাসে প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও কার্যকর একটি ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্যবর্তী সময়ে বজ্রাঘাতে অনেক মানুষের জীবন চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তাই প্রয়োজন সস্তা, সুলভ, স্বল্প সময়ে ও সহজে স্থাপন-প্রতিস্থাপন-পুনঃস্থাপনযোগ্য প্রযুক্তি যা কৃষক নিজেই তার মাঠে ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।

এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি টিম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে। এ প্রকল্পর জন্য প্রয়োজন কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা।

প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থান করে নেয়া বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমাদের জন্য অনেক গবেষণার দুয়ার খুলে দেবে আশা করা যায়।

মূলত ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে স্যাটেলাইট ট্রান্সপন্ডার বিক্রির পাশাপাশি সি-ব্যান্ডের ১৪টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে অন্তত একটি হলেও আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাজে বিশেষ করে বজ্রঝড়, বজ্রমেঘ ও বজ্রপাতবিষয়ক তথ্যাদি সংরক্ষণ ও প্রেরণের কাজে ব্যবহার করা হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী।

এখন তীব্র বজ্রঝড় কমেছে, কিন্তু এ বিষয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা বা অন্য করণীয়গুলো নিয়ে কথা বলা না থামিয়ে পরবর্তী বছরে মৃত্যুসংখ্যা কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সেন্সর, রাডার বা স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার থেকে স্থানীয় পর্যায়ে বজ্রপাতের পূর্বাভাসের মাধ্যমে মানুষের সুরক্ষা কী করে নিশ্চিত করা যায় তার বিশদ পর্যালোচনা ও কর্মপরিকল্পনা এখনই শুরু করতে হবে।

ড. এম এ ফারুখ : অধ্যাপক ও প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

[email protected]