মোয়াজ্জিন হয়ে জীবনের অর্থ খুঁজছেন দস্যু রাঙ্গা

ডেস্ক রিপোর্ট: সুন্দরবন, গোলপাতা আর লতাগুল্মের নান্দনিকতা। আছে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কতশত পশু-পাখির কিচির-মিচির। এতসব সৌন্দর্যের লীলাভূমিতেও বাস করে ভয়, আতঙ্ক।

না, বাঘে ধরবে, সাপে কাটবে- এ আতঙ্ক নয়। আতঙ্ক মানুষ নামের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীকে নিয়ে, সুন্দরবনে যাদের নাম দেয়া হয়েছে বনদস্যু। এরা অগ্নিশর্মা চোখে রাত-বিরাতে অবিরত ছুটে চলে, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। বারুদ পুড়িয়ে অন্যের স্বপ্ন কাড়ে, বোনে নিজের স্বপ্ন।

এদের কেউ ইচ্ছে করে বনদস্যু। কেউ বাধ্য হয়ে। কেউ বা প্রতিশোধের আগুন নেভাতে গিয়ে অন্ধকার গহ্বরে ডুবে গেছেন। দিন শেষে তাদেরও ভাবনায় আসে- আমি ভালো হব, অন্য সবার মতই সংসারী হব। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের দিন গড়ব। কিন্তু, দস্যুতা জীবনের একটিই পিছুটান- একবার যে এ পথে পা বাড়ায়, ফিরে যাওয়ার থাকে না উপায়। মরে না হয় মেরে টিকে থাকে।

এতেই কী জীবনের সমাপ্তি! না, দিনশেষে যে সুখ স্মৃতিগুলো সম্পদ, সেখান থেকেই দস্যুরাও ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে? হয় তো চায়, হয় তো না!

ভুল পথে সুন্দরবনের এসব স্বপ্ন বুনে চলা দস্যুগুলোর জন্যই আলোকবর্তিকা হয়ে আসেন মোহসীন-উল হাকিম। পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও যিনি গভীরে ভেবেছেন দস্যুদের একান্ত কষ্টগুলো। তাই তো বেসরকারি টেলিভিশন যমুনা টিভি’র এই বিশেষ প্রতিনিধি এগিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সুন্দরবনের আতঙ্ক দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

ইতোমধ্যে অনেকে ফিরে এসেছেন। আরও অনেকে আসার প্রক্রিয়ায় আছেন। কিন্তু, তাদের ফেরানোর পথে তাকে কতশত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিতে হয়েছে। গহীন বনে না খেয়ে, না নেয়ে ঘুরতে হয়েছে।

এরই মাঝে কোনো দস্যুর জীবনের গল্প শুনে হয়তো কেঁদেছেন, কারোটাতে ক্রোধে জ্বলেছেন। সে সব ক্ষুদ্র হাসি- কান্না, দুঃখ-বেদনা আর জীবন নিয়ে জীবন গড়ার জমিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো মোহসীন-উল হাকিম ‘জীবনে ফেরার গল্প’ শিরোনামে পরিবর্তন ডটকমের পাঠকদের জানিয়েছেন—

জীবনে ফেরার গল্প-২২
ছবির ব্যক্তির নাম মানজুর। বনদস্যুদের জগতে পরিচিতি রাঙ্গা নামে। দীর্ঘ দস্যুজীবন শেষে ঘরে ফিরেছেন। বলা যায়, ফিরতে পেরেছেন। সেই গল্প বলছি একটু পর…

দস্যু রাঙ্গা এখন নিজের গ্রামের মসজিদের মোয়াজ্জিন। দেখে চেনার উপায় নাই, এই লোকটিই প্রায় ১০ বছর দস্যুতা করেছে সুন্দরবনে।

রাঙ্গার সঙ্গে প্রথম দেখা রাজু বাহিনীর আস্তানায়। ২০১১ সালের কথা। রাজু বাহিনীর তখন একচ্ছত্র রাজত্ব সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকায়। টেলিফোনে কথা-বার্তা চলতে চলতে হঠাৎই ডেকে বসল রাজু। আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনার জন্য চলে গেলাম সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুবাহিনীর কাছে। সঙ্গে আমার সহকর্মী সোহেল রানা ও মোংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন।

খুলনা থেকে রওনা দিয়ে খুলনা সুন্দরবনের মোহাম্মদ আলীর দোয়ায় দেখা হলো। বড় বড় তিনটি ট্রলার নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করছিল বনদস্যুরা।

ভোরবেলা পৌঁছে দেখি প্রায় ৭০ জন সশস্ত্র দস্যু ট্রলারের ওপর দাঁড়ানো। আমাদের ট্রলার সেখানে ভিড়তেই আমি উঠে যাই তাদের ট্রলারে। তৃতীয় ট্রলারে রাজু থাকে। সেখানে আমাকে হাত ধরে টেনে তুলল যেই দস্যু তার নাম রাঙ্গা।

তখন থেকে শুরু করে বিদায় নেয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছিল এই দস্যু। তার ধারণা ছিল, কোনো না কোনোভাবে আমি তাদের ছবি তুলব এবং তা সরাসরি প্রচারিত হয়ে যাবে। তাই পুরো দিন তার নজরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

এই রাঙ্গার সঙ্গে দেখা হলো ২০১৬ সালের শেষের দিকে। তখন বনদস্যু নোয়া বাহিনীর সদস্য। সুন্দরবনের নিশানখালীতে দেখা হতেই তাকে চিনতে পারলাম। হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে দেখি, ডান হাতটি ঝুলছে। আগের বছর নিজের মধ্যে গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় রাঙ্গা। কপালটা ভাল ছিল, গুলি বুকে না লেগে হাতে লেগেছিল। বনের ভেতরে চিকিৎসা করাতে পারেনি। তাই হাতটা এক রকম নষ্টই হয়ে গেছে (সেই অভ্যন্তরীণ গোলাগুলির গল্প আরেক দিন লিখব…)।

যাই হোক, নোয়া বাহিনীর সদস্য হিসেবে রাঙ্গা আত্মসমর্পণ করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে জেলখানা। তারপর জামিন নিয়ে ফিরেছে নিজের বাড়ি। দীর্ঘ সময় দস্যুতা করেছে রাঙ্গা, দস্যুতা করে টাকাও কামিয়েছে। কিন্তু, আত্মসমর্পণের আগেই সেই টাকা সরিয়ে ফেলেছে তারই আপনজনেরা। বাড়ি ফিরে নিজের ক্ষতবিক্ষত হাতটা যে ঠিক করার চেষ্টা করবে, তার উপায়ও নাই।

আত্মসমর্পণের পর সরকারের দেয়া টাকা দিয়ে কোনো রকমে চলছে রাঙ্গা ওরফে মানজুর। তারপরও মনে কোনো আফসোস নাই। কারণ, একাধিকবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে সে। এখন জীবনে ফিরে বাকি দিনগুলো নিরিবিলি কাটিয়ে দিতে চায় সাবেক এই বনদস্যু। চলবে…।