হজ শুরু, লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাতের ময়দান

আজ পবিত্র হজ। আরাফাতের ময়দানে থাকার দিন। সেলাইবিহীন শুভ্র কাপড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারাবিশ্ব থেকে সমবেত মুসলমানরা আজ থাকবেন সেখানে। আকুল হৃদয়ে মহান রাব্বুল আলামিনকে বলবেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক।’ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই; সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।

মিনায় অবস্থান নেয়ার মধ্য দিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে পবিত্র হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতা। রোববার সারাদিন ও রাত তারা মিনায় কাটান ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মশগুল ছিলেন জিকির ও তালবিয়াতে। নামাজ আদায় করেন জামাতের সঙ্গে। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজিরা দিয়ে আত্মশুদ্ধি, মাগফিরাত ও রহমত চাইতে আসা এই মুসলমানরা আজ জড়ো হবেন আরাফাতের ময়দানে, যাকে হজের মূল অনুষ্ঠান বলা হয়।

সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৬৪ দেশের ২০ লাখের বেশি মুসলমান এবার হজ করছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। সৌদি গেজেট জানিয়েছে, হজ পালনে আসা মুসলমানরা রোববার ছিলেন মক্কা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে তাঁবুনগরী মিনায়। সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা, জাতীয়তার মানুষগুলো সময় কাটিয়েছেন ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে। সবার কণ্ঠে ছিল ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি। জিকির-আসকারের পাশাপাশি তাদের দেখা গেছে মোনাজাতে কেঁদে বুক ভাসাতে।

আজ সকালে তারা সমবেত হবেন প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে বিদায় হজের স্মৃতিজড়িত আরাফাতের ময়দানে। চার বর্গমাইল আয়তনের এ বিশাল সমতল মাঠের দক্ষিণ দিকে মক্কা হাদা তায়েফ রিংরোড, উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরও প্রায় পৌনে ১ মাইল বিস্তৃত। পবিত্র এ ভূমিতে যার যার মতো সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে তারা ইবাদত করবেন; হজের খুতবা শুনবেন এবং জোহর ও আসরের নামাজ পড়বেন।

সৌদি দৈনিক আল-আরাবিয়া জানিয়েছে, বাদশাহ সালমান এবার হজের খুতবা পড়ার দায়িত্ব দিয়েছেন মসজিদে নববীর ইমাম শেখ হুসেইন বিন আবদুল আজিজকে। এ খুতবা রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে বিশ্বময়।

আদি পিতা আদম (আ.) ও আদি মাতা হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতের ময়দানে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। ১৪শ’ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) দিয়েছিলেন তার বিদায় হজের ভাষণ।

এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে হজ পূর্ণ হয় না। তাই হজে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য। ইসলামী রীতি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হল হজ।

‘হে আল্লাহ, আমি হাজির’ জানিয়ে আজ এখানে মুসলমানরা অতীতের সব গুনাহ মাফের জন্য কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাবেন মহান আল্লাহর কাছে। কেঁদে বুক ভাসিয়ে চাইবেন আল্লাহর রহমত, জীবনের বাকি দিন ইসলামের পথে চলার সহায়তা। আকুতি জানাবেন প্রকৃত সফলতা অর্জনের, জান্নাতের বাসিন্দা হওয়ার। মাঠ, পাহাড়, পথ- সবখানে আজ থাকবে সেই রোনাজারি।

আরাফাত থেকে মিনায় ফেরার পথে আজ সন্ধ্যায় মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ পড়বেন সমবেত মুসলমানরা। মুজদালিফায় রাতে খোলা আকাশের নিচে থাকবেন তারা। এ সময়েই তারা সাতটি পাথর সংগ্রহ করবেন, যা মিনার জামারায় শয়তানকে উদ্দেশ করে ছোড়া হবে।

কাল সকালে মিনায় ফিরে সেই পাথর তারা প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে ছুড়বেন। এরপর কোরবানি দিয়ে ইহরাম ত্যাগ করবেন। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।

আরব নিউজ লিখেছে, যারা হজে এসেছেন, সবার কাছেই এ অভিজ্ঞতা জীবনের অনন্যসাধারণ এক ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে পাঁচ বছর আগে পালিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৫০ বছর বয়সী হিশমা মোস্তফা। এবার তিনি সৌদি আরবে এসেছেন হজ করতে। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম নিজের চোখে কাবা দেখার সুযোগ হল আমার। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা।’

ইয়েমেনের নাগরিক নায়েফ আহমেদ (৩৭) হজে এসেছেন জমি বিক্রির টাকায়। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে আসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এখানে এসে আমি শান্তি পাচ্ছি। আল্লাহর কাছে আমি দোয়া করব, যুদ্ধ যেন বন্ধ হয়।’ তিউনিসিয়া থেকে আসা ৫৯ বছর বয়সী নাজওয়া জানান, ২০০৭ সালে সৌদি আরবে ওমরাহ করে গেছেন তিনি। এরপর হজ করার জন্য রেজিস্ট্রেশন করলেও সুযোগ পেতে তার পেরিয়ে গেল দশটি বছর। তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতি আমি বোঝাতে পারব না, আমার চোখ প্রতিদিন ভিজে আসে।’

আরব নিউজ লিখেছে, হজে আসা মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য মক্কার চারপাশে ছয়টি চেকপয়েন্ট বসানো হয়েছে। সেখানে অনুমতিপত্র পরীক্ষা করে তারপর সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ২১ হাজার বাস। এই পুরো প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সৌদি সরকারের ১৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১ হাজার ৪৮৫ জন স্বেচ্ছাসেবী।

হজ অফিস ঢাকার পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশনের সদস্যসহ প্রায় আড়াইশ’ বাংলাদেশি কর্মকর্তা হজ পালনের সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে থাকবেন। তারা বাংলাদেশিদের জরুরি সেবা দেবেন। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় তিনটি মেডিকেল ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এসব ক্যাম্পে ৩০ চিকিৎসক ও নার্স হজযাত্রীদের চিকিৎসাসেবা দেবেন।