যশোর সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর

‘নানা রঙের ফুলের মেলা খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’ খ্যাত দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত ঐতিহ্যবাহী যশোর সরকারি মহিলা কলেজ। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে এতদ অঞ্চলের বিদ্যোৎসাহী প্রাণপুরুষ গণের নারী শিক্ষা বিস্তারে প্রচেষ্টার কৃতিত্বপূর্ণ কর্মের স্বাক্ষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে কলেজটি আজও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে নারী শিক্ষা উন্নয়নে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে।

ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত এই কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাসও ঘটনাবহুল। যশোরে অনেক আগে থেকেই নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলেও কার্যকর এবং সফল উদ্যোগ গৃহীত হয় বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দিকে। এই জেলায় ১৯৪১ সালে ‘যশোর কলেজ, (পরবর্তীকালে মাইকেল মধুসূদন কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে সহশিক্ষা প্রচলিত থাকায় মেয়েরাও অধ্যয়নের সুযোগ পেতেন। কিন্তু এই অঞ্চলের রক্ষণশীল সমাজের সভ্যগণ তাঁদের কন্যা সন্তানদেরকে উক্ত কলেজে (যশোর কলেজ) প্রেরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। ফলে এখানে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরী হয়ে পড়ে।

এই কাজটি সম্পাদনের লক্ষ্যে ২৮ আগস্ট, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে যশোরের জেলা প্রশাসক জনাব এ.বি.এম. গোলাম মোস্তফা (সি.এস.পি.)-এর সভাপতিত্বে যশোরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় যশোরে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৬৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ৪৭ জন ছাত্রী নিয়ে যশোর মহিলা কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। স্থানীয় মাইকেল মধুসূদন কলেজ ভবনের একটি অংশ প্রথমে কলেজটি চালু হয়। সেখানে ১৯৬৬ সনের ২০ জুলাই, পর্যন্ত ক্লাস চলার পর কলেজটিতে নিজস্ব নবনির্মিত দ্বিতল ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় প্রধানত জনসাধারণের প্রদত্ত চাঁদা ও স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে। অতঃপর সরকার কলেজটির উন্নয়ন কল্পে ১৯৬৫ সনে ৩,২০০ টাকা এবং ১৯৬৭-৬৮ সনে ৭০,০০০ টাকা প্রদান করেন। ১৯৬৬-৬৭ সনে কলেজের আবর্তক ব্যয় নির্বাহের জন্য ১৮,০০০ টাকা প্রদান করেন। ১৯৬৭ সনে স্নাতক শ্রেণীতে “মানবিক” এবং পরবর্তী বৎসরে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ‘বিজ্ঞান’ পাঠ্যক্রম প্রবর্তিত হওয়ায় কলেজটি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর জন্য যশোর শিক্ষা বোর্ড এবং স্নাতক শ্রেণীর জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কলেজটি অনুমোদিত হয়।

২.৮৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে বর্তমানে বিভাগের সংখ্যা ১৪ টি। তন্মধ্যে ৯ বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষসহ শিক্ষকের সৃষ্টপদ আছে মোট ৭২ টি । ৪৯০ আসন বিশিষ্ট ৩টি ছাত্রীনিবাস আছে। ৫টি ভবনে মোট ৪৭টি শ্রেণিকক্ষ আছে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এবং সেমিনার লাইব্রেরি মিলে প্রায় ২২,০০০ বই আছে। ‘প্রদীপ্ত স্বাধীনতা’ নামে একটি দর্শনীয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য আছে। কলেজ প্রশাসন এবং শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলেজের শিক্ষার মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে।

কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এম. হাসান সরোওয়ার্দীর সুদক্ষ নেতৃত্বে কলেজটি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। তিনি যশোর সরকারি মহিলা কলেজকে অত্র অঞ্চলের মধ্যে একটি আদর্শ মডেল কলেজে পরিণত করতে চান। অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এম. হাসান সরোওয়ার্দী কলেজের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজটি এই এলাকার নারী শিক্ষায় এবং সার্বিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি (পাস), ডিগ্রি (অনার্স) এবং মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদান করা হয়। বর্তমানে কলেজে ৯টি বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। কলেজের শিক্ষকবৃন্দ আন্তরিকতার সাথে নারী শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন। এই কলেজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী পরবর্তী কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করেছন এবং দেশের জন্য অবদান রাখছেন। শ্রেণিপাঠদান ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া অঙ্গনেও ছাত্রীদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। ছাত্রীরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া অঙ্গনে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়েও অবদান রাখছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় ধারণ করে কলেজের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। আমি আশা করি, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ নারী শিক্ষায় তথা সামগ্রিক শিক্ষায় প্রতিনিয়ত অবদান রেখে যাবে।’’

লেখক: মোঃ আশরাফুজ্জামান, প্রভাষক ইসলামরে ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ, যশোর।