বৈশ্বিক চাপ ও উদ্বেগ নিরসনে যৌথ প্রচারণা চালাবে সরকার-আ’লীগ

নির্বাচন প্রশ্নে কূটনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির দৌড়ঝাঁপের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য বৈশ্বিক চাপ ও উদ্বেগ নিরসনে সরকার ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে পাল্টা প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নীতিনির্ধারকরা বলছেন, যদিও ‘অসত্য’ তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিরোধী মহল বিশ্বব্যাপী প্রচারণায় নেমেছে তারপরও এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ হিসেবে তারা যেটা বলার চেষ্টা করেন তা হলো- বিরোধী মহল সব সময়ই সরকারের বিরুদ্ধে নানা কথা ছড়ায়। কিন্তু সরকারের শেষ সময়ে অর্কেস্ট্রেইটেড ক্যাম্পেইন বা ধারাবাহিক প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় ‘বহুমুখী বৈশ্বিক’ চাপ তৈরি হতে পারে।

এ আশঙ্কা থেকে এখনই আটঘাট বেঁধে বিশ্বব্যাপী জোর কদমে যৌথভাবে পাল্টা প্রচারণা চালাবে সরকার ও আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি সঙ্গে আলাপে সরকারের বিদেশ নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল এক প্রতিনিধি বলেন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্র্থীদের দিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটা যে বিরোধীদের ‘কাণ্ড’ ছিল সেটি দফায় দফায় ব্রিফ করে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবেচেয়ে সাড়া জাগানো ওই দুই মুভমেন্ট নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে খানিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। সরকার তা অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করেছে।

কেবল ঢাকা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়া এবং উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে এ নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা ব্রিফ করেছেন। ঢাকার বিশেষ নির্দেশনায় মিশন প্রধানরা স্ব স্ব দেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করে সেই উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করেছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট, বর্ধিত জোট বা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যে নামেই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মহল বিশেষ তৎপরতা চালাক না কেন সেটি প্রতিবেশী, কাছের এবং দূরের উন্নয়ন অংশীদার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে উদ্বেগ তৈরি করবে।

এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা হবে। প্রশ্ন আসবে। এটি মোকাবিলায় জোর প্রস্তুতি থাকতে হবে। সূত্র মতে, এ নিয়ে আজ তেজগাঁওয়ে একটি বৈঠক হবে। সেখানে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কিছু নির্দেশনা স্পষ্ট করা হবে। সরকারের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকাস, ইউরোপ, ইস্ট ইউরোপ এবং বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের প্রধানরা আমন্ত্রিত।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ঘনিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের তরফে কোনো বক্তব্য আসেনি। বরং গত সপ্তাহেই ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দিল্লি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না। সর্বতোভাবে তারা (দিল্লি) এ অবস্থান ধরে রাখতে চায়। তবে ঢাকায় দায়িত্বপালনকারী জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী চলতি মাসের সূচনাতে যে নিবন্ধ লিখেছেন তা নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে।
এটি কোনোভাবেই দিল্লির অবস্থান হতে পারে না মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতের বিদেশনীতিতে সাবেক বা প্রাক্তনদের খুব একটা পোক্ত অবস্থান নেই। তারা অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন, লিখতে পারেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিত বা ঢাকায় দায়িত্ব পালনকারী কোনো কূটনীতিক বললে বা লিখলে এটি ব্যাপক প্রচার পায়। তা নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনাও হয়।

এ নিয়ে সরকারের তরফে যথাস্থানে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হবে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা দিল্লি সফর করতে পারেন। সরকারি, বেসরকারি এবং অ্যাকাডেমিক আলোচনায় তিনি সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন। এটি খানিকটা হলেও বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বুঝতে দিল্লির জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করেন কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, কেবল ভারত নয়, সরকারের তরফে যখন যেখানে সুযোগ আসবে সেখানেই প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিরোধীদের প্রচারণার পাল্টা প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সাব-কমিটির পক্ষ থেকেও বিভিন্নভাবে এটি মোকাবিলার কৌশল রয়েছে।

গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটি আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এ নিয়ে কথাও হয়।

সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, জাতিসংঘের আমন্ত্রণ এবং তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করেছে। দলটি নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে- যা গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পড়ে না। এ সময় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে প্রকৃত ঘটনাগুলো এবং ইতিহাস তুলে ধরতে আহ্বান জানান তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সভায় বেশ কয়েকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত তাদের মতামত তুলে ধরেন।

তারা বলেন, সরকারের ইতিবাচক কর্মকান্ড বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে বিদেশে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিতে এলিট শ্রেণির লোকদের আনতে হবে। পরে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, দলের কোনো সংকটের সময় এলিটরা কেটে পড়ে। হঠাৎ করে তারা দলনিরপেক্ষ হয়ে যান। কিন্তু দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা নানাভাবে ফায়দা হাসিল করেন। যারা চরম দুঃসময়েও আওয়ামী লীগকে ছেড়ে যায় না বা যাবে না তাদের দিয়েই দলের কমিটি গঠন করতে হবে।

শাম্মী আহমেদ আরো বলেন, ’৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের এলিট হিসেবে যারা পরিচিত ছিল তারা রাতারাতি সুর বদল করে ফেলেছিল। দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে সাধারণ নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলন করেছে। এক এগারো সরকারের শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরাই শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে। তখন আমরা এলিটদের খুঁজে পাইনি। কর্মশালায় আরো বক্তব্য রাখেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, ওয়ালিউর রহমান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ প্রমুখ।

আগামী নির্বাচন সময়মতো এবং সুষ্ঠুভাবে হবে-ড. গওহর রিজভী: ওদিকে গতকাল ঢাকায় বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী আগামী নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা করেন।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে নির্বাচন যে প্রশ্ন রয়েছে তার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সব বাধা উপেক্ষা করে আগামী জাতীয় নির্বাচন সময়মতো এবং সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। সকল রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবে আশা করে তিনি বলেন, নির্বাচন যথাসময়ে হবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনে অংশ নিতে যেকোনো রাজনৈতিক দলের কোনো বাধা থাকবে না।
ড. রিজভী বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সমাজ রয়েছে। আমরা স্থিতিশীল সমাজ নিয়ে এগিয়ে যাব, এখানে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

নির্বাচনের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ব্যক্ত করে দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকা সরকারের ওই জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি বলেন, নির্বাচনের ফল কি হবে সেটি বরাবরই অনিশ্চিত (আনসারটেইন)। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়েও ব্যবসায়িক নীতিমালা এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। আমরা এগিয়ে যাবো। এ সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন স্থান দখল করেছে। গত ১০ বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে প্র্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আরও বেশি করে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এফবিসিসিআইয়ের ব্যবসায়ী নেতারা, অন্যান্য সংগঠন ও দ্বিপক্ষীয় চেম্বারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সূত্র: মানবজমিন