এশিয়া কাপের সবচেয়ে গুরুত্বহীণ ম্যাচটাই কী নাটকীয়তায় ভরে উঠলো। ভারতের ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গেছে আগেই, আফগানিস্তানের ছিটকে যাওয়া। আফগানরা দারুণ ক্রিকেট খেলছে, তারপরও দুই দলের শক্তির ব্যবধানটাও তো এসে যায়। সেই হিসেবে মঙ্গলবার দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অন্যদিনের তুলনায় দর্শকদের চোখ যে খানিক কম ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কিন্তু অবহেলায় যারা ম্যাচটি দেখেননি, সত্যিই তো তাদের হতভাগাই বলা হবে। ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় ৩৬তম বারের মতো ওয়ানডে ম্যাচের ফল ‘টাই’ লেখা হলো এদিন। সেটিও কিনা ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে আগে ব্যাটিং বেছে নিয়েছিল আফগানিস্তান। আফ্রিদির রেকর্ড ছুঁয়ে সেঞ্চুরি করেন এদিন মোহাম্মদ শাহজাদ। তার ১১৬ বলে ১২৪ রান ও মোহাম্মদ নবীর ৬৪ রানে ভর করে ৮ উইকেটে ২৫২ রান করে আফগানরা। জবাবে রশিদ খানের করা শেষ ওভারে ১ বল বাকি থাকতে ভারতের ইনিংস শেষ হয় ঠিক ২৫২ রানে।
রশিদ খান যখন শেষ ওভারটি করতে এলেন, ভারতের চাই ৬ বলে ৭ রান। শেষ উইকেট জুটিতে ব্যাট করছেন রবীন্দ্র জাদেজা ও খলিল আহমেদ। একজন জাদেজা ছিলেন বলেই নাটকের শেষটায় নিজেদের হাসি দেখতে উন্মুখ ছিলেন ভারতীয় দর্শকরা। রশিদের প্রথম বলে তো এক রান নেওয়ার মতো হলেও রান নিলেন না। পরের বলে স্লগ সুইপে চার হাঁকিয়ে ভারতীয় দলকে কিছুটা নির্ভার করলেন জাদেজা। সমীকরণ সহজ হয়ে দাঁড়াল, ৪ বলে ৩ রান।
তৃতীয় বলটিতে ১ রান নিলেন জাদেজা। খলিল আহমেদ স্ট্রাইকে। নড়েচড়ে বসল আফগান ফিল্ডিং বিভাগ। কিন্তু রান আউটের ভয়কে জয় করে চতুর্থ বলে দুরন্ত গতিতে ১ রান নিলেন এই পেসার। দুই দলের স্কোর তখন সমান। শেষ দুই বলে জয়ের জন্য ১ রানের সমীকরণ দাঁড়াল ভারতের সামনে। জাদেজা যখন ব্যাটিংয়ে তখন আর ভয় কী! কিন্তু বোলিংয়ের তো রশিদ খান। কি মনে করে ডিপ মিডউইকেটে হাওয়ায় ভাসিয়ে শটটি খেললেন জাদেজা। নাজিবুল্লাহ জাদরান দৌঁড়ে এসে লুফে নিলেন ক্যাচ। ফলে এশিয়া কাপের ভারত-আফগানিস্তান গুরুত্বহীণ ম্যাচটিই রূপকথার ‘টাই’ হয়ে থাকল।
আউট হওয়ার পর হতাশায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলেন জাদেজা। ভারতীয় দর্শকরা হতবাক। ওদিকে মাঠে আফগান উৎসব চলছে। দেখে যে কারো মনে হবে ভারতকে হারিয়ে আফগানদের উদযাপন। আসলে জয়ের চেয়েও এই ম্যাচটা কম কি! আফগান ক্রিকেট ইতিহাসে নিশ্চিতভাবে চিরস্মরণ যোগ্য হয়ে থাকবে এই ম্যাচ।
তাছাড়া সুপার ফোর থেকে আফগানরা তো বিদায় নিল তো আসলে মাথা উঁচু করেই। পাকিস্তানের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর ম্যাচে বোলিংয়ে শেষ ওভারে হেরে যাওয়া। এরপর বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ ওভারে সমীকরণ মেলাতে ব্যর্থ তাদের ব্যাটসম্যানরা। আর বিদায় নেওয়ার আগে ভারতের বিপক্ষেও গল্পগাঁথা। এর আগে গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে হারানো। এই এশিয়া কাপ আসলে আলাদা করে মনে রাখবে আফগানদের।
অথচ ২৫৩ রানের লক্ষ্যে দুই ওপেনার লোকেশ রাহুল ও অম্বতি রাইডু কি দুর্দান্ত শুরুটাই না এনে দিলেন ভারতকে। ১৫.২ ওভারেই ১০০ রান পূরণ করে এই জুটি। মোট ১১০ রানের উদ্বোধনী জুটি এই দুজনের। অম্বতি রাইডুকে ফিরিয়ে জুটিটি ভাঙেন মোহাম্মদ নবী। ৪৯ বলে ৪ টি চার ও ছক্কায় এই রান করেন রাইডু। এরপর লোকেল রাহুলকে শিকার বানান রশিদ খান। ৬৬ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় ৬০ রান করেন রশিদ।
ভারতীয় দল পথ হারাল এরপরই। আফগান বোলাররা নিয়মিত বিরতিতে তুলে নিতে থাকে উইকেট। ভারতের দলীয় ১৪২ রানে জাভেদ আহমেদি ফিরিয়ে দেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে (৮)। তিন নাম্বারে নামা দিনেশ কার্তিকের সঙ্গে এরপর মনিষ পান্ডের ২৪ রানের জুটি। ৮ রান করা পান্ডেকে ফেরান আফতাব আলম।
দিনেশ কার্তিক এবং কেদার যাদব ৩৮ রানের জুটি গড়লেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক রান আউটের শিকার যাদব। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট বলতে হবে সেটিকেই। ভারতের বিপদের আভাস এরপর সত্যি হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। তিন নম্বরে নামা দিনেশ কার্তিকও বিদায় নেন ৪৪ রান করে। ২০৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত।
অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নামা দ্বিপক চাহার ১২ রান করে আফতাব আলমের শিকার হলেন। এর মধ্যে আবার পর পর দুটি রান আউট। কুলদ্বিপ যাদব ফিরেন ৯ রান করে। ০ রান করে ফিরেন সিদ্ধার্থ কাউল। সিদ্ধার্থ ফিরতে ভারতের রান ৪৮.৫ ওভারে ৯ উইকেটে ২৪৫-এ দাঁড়ায়। এরপর শেষ ওভারের রোমাঞ্চের সমাপ্তি টাইয়ের মধ্য দিয়ে।
আফগানদের পক্ষে সর্বাধিক ২টি করে উইকেট নেন রশিদ খান, আফতাব আলম ও মোহাম্মদ নবী। ১ উইকেট নিয়েছেন জাভেদ আহমেদি।
ভারত ম্যাচটিতে অবশ্য অধিনায়ক রোহিত শর্মাসহ পাঁচজনকে বিশ্রাম দিয়ে মাঠে নেমেছিল। দুই পেসার ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহর সঙ্গে যুজবেন্দ্র চাহাল ও শিখর ধাওয়ানকেও বিশ্রাম দেওয়া হয় ম্যাচে। ভারতকে এম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তৃতীয় অধিনায়ক হিসেবে ছুঁয়েছেন কোনো দেশকে ওয়ানডেতে ২০০ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার অনন্য কীর্তি।
ভারতের বোলিংয়ের সামনে এরআগে অবশ্য গল্পগাঁথার জন্ম দেন মোহাম্মদ শাহজাদ। ১১৬ বলে ৭ ছক্কা ও ১১ চারে ১২৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। অথচ টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডারের অন্য সব ব্যাটসম্যান এদিন ব্যর্থ। ৮৮ বলে যখন সেঞ্চুরি পূরণ করলেন তখন আফগানদের দলীয় স্কোর ১৩১। যা তাকে আফ্রিদির ১৩ বছরের রেকর্ডের পাশে বসিয়ে দেয়। দলীয় সবচেয়ে কম রানে সেঞ্চুরি ছোঁয়ার রেকর্ড এখন আফ্রিদি ও শাহজাদের। ২০০৫ সালে আফ্রিদিও রেকর্ডটি গড়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে।
আফগানদের রানটা এরপর ২৫২-তে গিয়ে পৌঁছার অবদান মোহাম্মদ নবীর। ৫৬ বলে ৩ চার ও ৪ ছক্কায় ৬৪ রান করেন তিনি। ভারতের পক্ষে সর্বাধিক ৩ উইকেট নিয়েছেন রবীন্দ্র জাদেজা। ২ উইকেট নেন কুলদ্বিপ যাবদ। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন খলিল আহমেদ, দ্বিপক চাহার ও কেদার যাদব। ম্যাচ সেরা হয়েছেন মোহাম্মদ শাহজাদ।