ভোটে আলেমদের দোয়া কামনা প্রধানমন্ত্রীর

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আলেম ওলামাদের দোয়া চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সৃষ্টিকর্তা তাকে আবার দেশের সেবা করার সুযোগ দেবেন-এটাই কামনা করেছেন তিনি। বলেছেন, যদি উল্টোটাও হয়, তার কোনো আফসোস থাকবে না।

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার আইন পাসের ফলে কওমি আলেমরা রবিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী তার ২২ মিনিটের বক্তব্যে নিজের, পরিবারের এবং দেশের মানুষের জন্য জন্য দোয়া চান।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের দোয়া চাই। সামনে নির্বাচন আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি ইচ্ছা করেন, নিশ্চয় আবার তিনি বাংলাদেশের মানুষের খেদমত করার সুযোগ আমাকে পাবেন। আর যদি আল্লাহ না চান, দেবেন না, আমার আফসোস থাকবে না। কারণ, আমি সব কিছু আল্লাহর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি।’

‘আমি পিতা-মাতা, ভাই সব হারিয়েছি, আমি নিঃস্ব রিক্ত, আমি এতিম, আমরা দুটি বোন আছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতনির জন্য দোয়া করবেন। তারা যেন সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে থাকতে পারে।’

‘আর দোয়া করবেন বাংলাদেশের জন্যগণের জন্য। আমি যখন নামাজ পড়ি, দোয়া করি, আমি আমার, ছেলে মেয়ে নাতিপুতিদের জন্য যখন দোয়া করি, সেই সাথে সাথে আমার সাথে যারা কাজ করে, তাদের জন্য দোয়া করি, দোয়া করি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য।’

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে কওমি আলেমদের উপস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামির স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে এই বিলও পাস হবে।

এই দাবিটি কওমি আলেমদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। তাদের ১৪ বছরের শিক্ষা জীবনের কোনো স্বীকৃতি না থাকায় এতদিন তারা কোনো চাকরিতে যোগ দিতে পারতেন না।

১৯৯৯ সালে বিএনপি এবং আদর্শিক ‘শত্রু’ জামায়াতের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল ইসলামী ঐক্যজোট জোটবদ্ধ হয় কওমি সনদের স্বীকৃতির আশ্বাসে। তবে সেই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এই স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী। আলোচনা করেন আলেমদের সঙ্গে। কিন্তু তাদের মধ্যে বিরোধের জেরে ভেস্তে যায় এই উদ্যোগ। তবে আট বছর পর প্রধানমন্ত্রীর সেই উদ্যোগ সফল হয়। আর এর পরই শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়ার আলোচনা হয়।

পরে গত ২৩ অক্টোবর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন আল্লামা শফির নেতৃত্বে আলেমরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা নিতে চাননি। পরে সেই বৈঠকেই শোকরানা সমাবেশের সিদ্ধান্ত হয়।

রবিবার সকাল থেকেই কওমি আলেম এবং ছাত্ররা দলে দলে সোহরাওয়ার্দীর ময়দানে আসতে থাকে। এই সমাবেশে যোগ দেন সারাদেশের কওমি মাদ্রাসার আলেম ওলামারা।

প্রধানমন্ত্রীর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বীকৃতি থাকতে পারে না, এটা হতে পারে না। এই স্বীকৃতি আগেও ছিল জানিয়ে তিনি জানান, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে এই স্বীকৃতি বাতিল হয়।

সনদের এই স্বীকৃতি পাওয়ায় কওমি শিক্ষার্থীরা দেশে বিদেশে চাকরি পারে, তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে বলে প্রধানমন্ত্রী আনন্দিত। বলেন, ‘সে সুযোগটা আমরা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য করে দিতে পেরেছি। তাদের জীবনটা সুন্দর হবে, সুন্দরভাবে তারা বাঁচতে পারবে।’

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণ কওমি মাদ্রাসা থেকেই শুরু হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তারাই কওমি মাদ্রাসা করেছিলেন। কাজেই তাদেরকে আমরা সব সময় সম্মান করি।’

‘ইসলাম ধর্ম মানুষকে শান্তির পথ দেখায়। আর সে দ্বীন শিক্ষা যারা দেয়, তারা কেন অবহেলিত থাকবে? কাজেই তাদের কখনও অবহেলিত থাকতে দেয়া যায় না।

কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বাতিল করেছিলেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তুলে ধরেন বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা এবং বেঁচে যাওয়ার বিষয়টি। বলেন, ‘কখনও গ্রেনেড হামলা, কখনও গুলি, কখনও বোমা, নানাভাবে আমাকে বারবার হত্যার চেষ্টার পরও আমি যে বেঁচে যাই, আমার মনে হয় আল্লাহরই কোনো ইশারা। আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাবেন, যে কারণেই তিন বারবার আমাকে রক্ষা করেছে।’

কওমি আলেমদের ভূয়সী প্রশংসাও করেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে এই মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করছে। সবচেয়ে বড় কথা যখন তারা এতিম হয়ে যচ্ছে, যারা হতদরিদ্র বা যাদের যাওয়ার জায়গা নাই, আপনারা তাদেরকেই আশ্রয় দেন, তাদেরকে খাদ্য দেন, তাদেরকে খাদ্য দেন, তাদেরকে শিক্ষা দেন। তারা অন্তত একটা আশ্রয় পায়।’

‘এতিমকে আশ্রয় দিচ্ছেন। এর চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে? কাজেই যেখানে আপনাদের স্বীকৃতি দেব না এটা কখনও হতে পারে না। তাই আমি যখনই সরকারে এসেছি, চেষ্টা করেছি। আমরা যখনই আমরা যে শিক্ষা নীতিমালা ঘোষণা করেছি, সেই নীতিমালায় ধর্মীয় শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছি। কারণ, আমি মনে করি, একটা শিক্ষা তখনই পূর্ণাঙ্গ হয়, যখন ধর্মীয় শিক্ষাও সেই তাখে গ্রহণ করা যায়।’

‘লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে, অথচ তাদের সেই ডিগ্রির যদি স্বীকৃতি না থাকে তাহলে তারা কোথায় যাবে, কী করবে, কী করে তারা চলবে?’

ইমাম মোয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট, মসজিদভিত্তিক উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ সম্প্রসারণ, স্বতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বাংলাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক কালচারাল সেন্টার করার উদ্যোগও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের উন্নয়নে তার চেষ্টার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে যেটুকু শক্তি দিয়েছেন, আমি বাংলাদেশের মানুষের, জনগণের খেদমত করতে চাই। বাংলাদেশকে একটা সুন্দর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

‘বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, তারা যেন কোনো কষ্ট না পায়, তাদের যেন সব সময় আল্লাহ হেফাজত করে, তাদের যেন সব সময় আল্লাহ সহায় হন, সেই দোয়াই আমি সব সময় করি।’

ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে নানা অপপ্রচার চলছে উল্লেখ করে এতে কান না দিতেও অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, মহানবী (সা.) কে নিয়ে কোনো অপপ্রচার হলে তার শাস্তি হবে। তবে এ জন্য কেউ যেন হাতে আইন তুলে না নেয়, সে অনুরোধও করেন তিনি।

ইসলাম শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু মানুষের কারণে ধর্মের বদনাম হচ্ছে। মুসলমানদের হানাহানিতে উপকৃত হচ্ছে তারা যারা অস্ত্র বিক্রি করে। আর রক্ত ঝরে মুসলমানদের।