জগলু হত্যাকান্ড : শ্বাসরোধ করে স্ত্রী তাহমিনা, জবাই করে আলামিন ও মুরসালিন

ঝিনাইদহের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর গাড়িচালক এটিএম হাসানুজ্জামান ওরফে জগলুকে স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা (৩৭) দুই প্রেমিকের সহযোগিতায় হত্যা করেছেন। শনিবার (৩১ আগস্ট) স্বামী হত্যায় স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে তিনি দুই পরকীয়া প্রেমিকের সহায়তায় স্বামীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। আদালতেও তাহমিনা পারভীন তমা ১৬৪ ধারায় জবান বন্দিতে হত্যার দ্বায় স্বীকার করে ঘটনার বর্ননা দেন।

নিহত জগলু কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জুগিয়া স্কুলপাড়া এলাকার মৃত জহুরুল আলমের ছেলে। গত ২৮ আগস্ট যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের চুড়ামনকাটি বারীনগরের মাঝামাঝি এলাকার মাঠে লাশ পাওয়া যায়।

রোববার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম. কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, শনিবার জগলু হত্যা মামলার আসামি তার স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যার পরিকল্পনা ও মিশন বাস্তবায়নের কথা স্বীকার করেছেন। দাম্পত্য কলহ ও পরকীয়ার জেরে হত্যাকান্ড ঘটেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক গাজি মাহাবুবুর রহমানের কাছে স্বামী হত্যার ঘটনার বর্ননায় স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা জানান, ১৯৯৯ সালে নিহত এটিএম হাসানুজ্জামান ওরফে জগলুর সাথে আসামী তাহমিনা পারভীনের বিয়ে হয়। তাদের সংসার জীবনে দুই ছেলে-মেয়ে আছে। স্বামী ২০০৮ সালে সাসপেন্ড হওয়ার পর সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এর জের ধরে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। তখন থেকে তাদের দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় ঘটে। তাহমিনা ঢাকায় বসবাসকালে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। গত ২৬ আগস্ট মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে তাহমিনা পারভীন তার ছেলের বাসায় যান। ওইদিন তাহমিনার সাথে তার স্বামীর মোবাইল ফোনে ঝগড়া হয়। হাসানুজ্জামান তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সন্ধ্যার পর ছেলের বাসার সামনে রাস্তায় নেমে এসে বন্ধু আলামিন ও মুরসালিনকে মোবাইল ফোন করে আসতে বলেন। তারা দুজন আসার পর হত্যার পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আলামিন ও মুরসালিন মিরপুরের একটা ওষুধের দোকান থেকে পাতলা কাঁচের বোতলে চেতনানাশক ওষুধ এবং ফাঁস দেওয়ার জন্য দড়ি সংগ্রহ করেন। এরপর একটা উবারের গাড়িতে ওঠেন। গাড়িচালকের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায়। তিনি তাহমিনা পারভীন ও তার বন্ধুদের পূর্বপরিচিত। বিভিন্ন সময় তাদের প্রয়োজনে তাকেই ডেকে নেন। এরপর তাহমিনা পারভীন মুরসালিনের মোটরসাইকেলে ও আলামিন উবারের গাড়িতে কেরানীগঞ্জের বাসায় চলে যান। ২৭ আগস্ট ভোর আনুমানিক ৫টার দিকে পাটুরিয়া ঘাট পার হয়ে ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাহমিনাসহ তার বন্ধুরা যশোরে পৌঁছান। ১২টার দিকে গাড়ি নিয়ে যশোর ‘জাবির ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলে যান। তাহমিনা পারভীন আলামিন ও মুরসালিনের পরিচিত যশোরের একজনকেও হোটেলে দেখতে পান। তারা সবাই লিফ্টে দোতলার রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে তাহমিনা পারভীন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হন। রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া শেষে স্থানীয় ব্যক্তির বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন। এরপর তারা গাড়ি নিয়ে উবারের গাড়ির ড্রাইভারের বাড়িতে যান। এসময় স্বামী জগলু তাহমিনা পারভীনকে ফোন দিলে তিনি তাকে বলেন, থ্রী-পিচ ও কসমেটিকস মালামাল কেনার জন্য যশোর এসেছেন। তখন ভিকটিম হাসানুজ্জামান তার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলে, তাহমিনা বলে বিশ হাজার টাকা দেয়া যাবে। কোথা থেকে টাকা নিবা ? তখন ভিকটিম হাসানুজ্জামান ঝিনাইদহ শামীমা ক্লিনিকের সামনে টাকা নেয়ার কথা জানায়। তাহমিনা ও তার বন্ধুরা যশোরে ঘুরাফেরা করে সময় কাটাই। সন্ধ্যার পরে ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে রওনা করে। রাত অনুমান ১০টার দিকে ঝিনাইদহ শামীমা ক্লিনিকের সামনে পৌছায়ে তাহমিনা তার স্বামীকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। ভিকটিম হাসানুজ্জামান পিছনের ছিটের মাঝখানে, আসামী তাহমিনা ভিকটিমের বামে এবং আলামিন ডানে বসে। মুরসালিন গাড়ির সামনের ছিটে বসে। ঝিনাইদহ শহর পার হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাহমিনা পারভীন ও আলামিন দুইদিক থেকে ভিকটিমের দুই হাত ধরে।
আলামিন চেতনানাশক ঔষধ তুলা ভিজিয়ে ভিকটিম হাসানুজ্জামানের নাকে চেপে ধরলে সে অচেতন হয়ে যায়। তখন আলামিন, মুরসালিন ও তাহমিনা পারভীন রশি দিয়ে ভিকটিম হাসানুজ্জামানের গলা পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। ড্রাইভার গাড়ি যশোরে দিকে চালাতে থাকে। প্রায় ৪০মিনিট পথ যাওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গায় রাস্তার ডান দিকে গাড়ি থামিয়ে আলামিন ও মুরসালিন ভিকটিম হাসানুজ্জামানের মৃতদেহ গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তার ডান পাশে ঢালে ফেলে দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আলামিন ও মুরসালিন ভিকটিমের গলায় ছুরি দিয়ে জবাই করে। তাহমিনা পারভীন গাড়িতে বসে ছিল। এরপর আলামিন ও মুরসালিন তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠে এবং ঢাকার দিকে রওনা দেয়। ঢাকা যাওয়ার পথে মুন্সিগঞ্জে মুরসালিনের খালার বাসায় উঠে। সেখানে ড্রাইভার, আলামিন ও মুরসালিন গাড়ি ধুয়ে ফেলে। তাহমিনা পারভীনের পরনে থাকা পোশাক ঐ বাসায় খুলে অন্য কাপড় পরে সকলে ঢাকা চলে যায়।

রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) তাহমিনা পারভীন তমাকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট গৌতম মল্লিকের আদালতে হাজির করা হলে ১৬৪ ধরার স্বীকারোক্তি জবান বন্দিতে একই বর্ননা দেন।