তামাক শিল্পে শিশুশ্রম নিষিদ্ধে-এখনই প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ

তামাক শিল্পে শিশুশ্রম এক অমানবিক পেশার নাম। যেখানে শিশুদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অসুস্থ ভবিষ্যৎ এর দিকে। দেশের ক্ষুদ্র কৃষকরা সাংসারিক খরচ কমানোর জন্য ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দিয়ে তামাক কারখানা ও তামাক ক্ষেতে কাজ করান। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা সত্ত্ব্ওে অনেক কৃষক তা মানেননা।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশু অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ শিশুর স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিপদের আশঙ্কা আছে এমন সব কাজে যেন শিশুদের ব্যবহার করা না হয় তার ব্যবস্থা নেবে’। আইন অনুযায়ী তামাক শিল্পে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ।

শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বাস্থ্য হানিকর কাজের তালিকায় বিড়ি ও তামাক শিল্পের নাম থাকলেও শিশুশ্রমের ও পরনির্ভর করে চলছে এ শিল্প। দেশের দারিদ্র পরিবারের শিশুদের দেয়া শ্রমই তামাক কারখানা গুলো টিকিয়ে রেখেছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বাস্থ্যহানিকর ৩৮টি কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ২০১৩ সালে সরকার চিহ্নিত বিড়িও তামাক শিল্প রয়েছে চতুর্থ স্থানে।

বাংলাদেশে তামাক শিল্প সমীক্ষায় দেখা যায় দেশের শুধুমাত্র ১১৭টি বিড়ি কারখানায় প্রায় ৬৫ হাজার লোক কাজ করে। এদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। আইএলও বলছে, তামাক শিল্প শিশুদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কর্মক্ষেত্র। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচন্ড গরমে, বিষাক্ত পদার্থ নিয়ে কাজ করতে হয় শিশুদের। বেশির ভাগ তামাক কারখানায় শিশুরা কমপক্ষে দিনে ১০ ঘণ্টা করে ও কাজ করে। তামাক ক্ষেতের শিশু শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই নানা রকম কঠিন অসুখ বিসুখে ভুগে থাকে। যেমন প্রচন্ড মাথা ও পেট ব্যথা, কাশি ও শ্বাসকষ্ট এসব লেগেই থাকে তাদের। এছাড়া নিকোটিনের বিষাক্ত ধোয়া মস্তিষ্কের কাঠামো ও কার্যক্ষমতার ওপর ও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এসব অভিযোগ গুলো সাধারণ নয়। তামাক শিল্পে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকরা বিভিন্ন রোগে ভুগছে, যাকে ‘সবুজ দুর্বলতা’ বা‘ নিকোটিন বিষক্রিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে রোগের লক্ষণ হিসেবে মাথাব্যথা, তলপেটব্যথা, পেশির দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, বমি হওয়া, উচ্চ রক্ত চাপ এবং হার্টের কম্পন বৃদ্ধিকে শনাক্ত করা হয়েছে। শুধু তামাকজাত শিল্পকারখানা ই নয় তামাক চাষ হয় এমন জেলা গুলোতে শিক্ষার্থীরা তামাক জমিতে শ্রমিকের কাজ করছে। অবসরে তারা কেউ তামাকের গাছ থেকে পাতা ভাঙছে, আটি বাঁধছে, পাতা শুকাচ্ছে, গাছের আগাছা পরিষ্কার করছে আবার কেউ শুকানো তামাকগুলো বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। দিন শেষে মজুরি জনপ্রতি তারা পাচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও ২০১৫ সালে বিধিমালা পাস হওয়ার পর মানুষের মধ্যে আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখতে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ এর গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু এ সম্পর্কে টাস্কফোর্স সদস্য ও মানুষের মধ্যে জানার পরিধি খুবই কম। তাই ধূর্ত তামাক কোম্পানি গুলো আইন বাস্তবায়নে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শিশুশ্রমিক কাজে নিযুক্তকরনে তামাক কোম্পানির সব অপকৌশল কঠোর ভাবে বন্ধ হ্ওয়া দরকার।

বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা কনভেনশন নং- ১৮২ অনুসমর্থন করেছে। শিশু অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত এ সববিধি-বিধান কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় তামাকজাত পণ্যের কারখানার মালিকরা ঝুঁকিপূর্ণ তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে শিশুশ্রম ব্যবহার করছে। ২০১০ সালে আমেরিকার শ্রম বিভাগের এক তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের পর আমেরিকায় বিশ্বের অধিকাংশ বড়বড় তামাক শিল্পগুলো গড়ে ওঠে। বর্তমানে বিশ্বে ৮৫ শতাংশ তামাক উৎপাদন হয় বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলে। যেখানে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্রের গবেষক মার্টি ওথানজ বলেন, বিশ্বে যেসব উন্নয়নশীল দেশে তামাক উৎপাদন হয় সেখানে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের বয়স সাধারণত পাঁচবছর থেকে শুরু হয়।

তামাক শিল্পে শিশু শ্রম বন্ধ করতে হলে অবশ্যই এ শিল্পে শিশু অধিকার আইন বাস্তবায়ন সহ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সঙ্গে সরকারের প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার,সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সাথে সকল ধরনের সংশ্লিষ্টতা পরিহার করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট হারে তামাক কর বৃদ্ধি করতে হবে যেন তামাক শিল্পে শিশু শ্রম বন্ধ, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির কোন হস্তক্ষেপ না থাকে।

-শাপলা রহমান
সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী।