কক্সবাজারে ৩৪ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুখ হোসেন খানের বিরুদ্ধে কারবারিদের সঙ্গে ইয়াবা ভাগাভাগির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সীমান্তে চোরাচালান ও ব্যবসায়ীকে ধরে এনে নির্যাতনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন এই কর্মকর্তা। সম্প্রতি তার দুটি অডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখান থেকে কিছু ভয়ংকার তথ্য উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি একটি অভিযানে জব্দ হওয়া বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালান তিনি ভাগ করে ফের কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। যুগান্তরের হাতে আসা দুটি চাঞ্চল্যকর অডিও ক্লিপে ফারুখকে অভিযানের নামে মাদক ভাগাভাগি এবং নাটকীয় অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। অডিওগুলোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি এর সত্যতা স্বীকার করেন। তবে তার ভাষ্য, এটি ছিল ‘অভিযানের কৌশল’ এবং তিনি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, লে. কর্নেল ফারুখ হোসেন খানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরপরই প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে তাকে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিজিবি একটি পেশাদার ও দায়িত্বশীল বাহিনী। বাহিনীর কোনো সদস্য যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন বা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে-সে যত উচ্চ পদেই থাকুক না কেন। বিষয়টি আমরা অভ্যন্তরীণ তদন্তের আওতায় আনব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ইয়াবা ভাগাভাগি : যুগান্তরের হাতে আসা অডিও ক্লিপে বিজিবির এক সোর্সকে কর্নেল ফারুখের সঙ্গে ইয়াবা ভাগাভাগি ও ডেলিভারি নিয়ে আলাপ করতে শোনা যায়। সংলাপটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
সোর্স : স্যার, আসসালামু আলাইকুম। স্যার, ভালো আছেন?
ফারুখ : ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো।
সোর্স : স্যার, বিষয়টা হচ্ছে আমি শাহাজান ভাইকে বলেছি। মাল আসবে-২০ কার্ড ইয়াবা (প্রায় ২ লাখ পিস)। এর মধ্যে ১৫ কার্ড আপনারা যা করার করবেন, আর ৫ কার্ড (৫০ হাজার পিস) আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে আরও দুজন থাকবে। আপনারা চালানটা বুঝে নেবেন পাগলীর বীল রোডের মুখ থেকে-হোটেল ওয়াকিয়ার পাশে। আমার সঙ্গে ড্রাইভার থাকবে, আরও দুজন থাকবে-মোট চারজন। আপনারা শুধু ড্রাইভারকে আসামি করবেন, এটুকু অনুরোধ।
ফারুখ : আইচ্ছা। মেরিন ড্রাইভের কোনো নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে নিতে পার।
সোর্স : সেটা আপনারা ঠিক করবেন, স্যার।
ফারুখ : তোমাকে ৫ কার্ড দিয়ে দিতে হবে, এই তো?
সোর্স : হ্যাঁ, স্যার।
ফারুখ : ঠিক আছে।
সোর্স : স্যার, কাল আমরা ইফতারের পরপর গাড়ি নিয়ে টান দেব। আপনি ইফতারের আগে আগে রেডি থাকবেন।
ফারুখ : ঠিক আছে।
সোর্স : মরিচ্চা চেকপোস্টের আগে আগে ডেলিভারি দিতে হবে, স্যার।
ফারুখ : আচ্ছা, ঠিক আছে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, কথামতো ৩০ মার্চ, ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় কক্সবাজার সদরের পাগলীর বিল রোড থেকে একটি নাটকীয় অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ইয়াবার চালান জব্দের কথা থাকলেও তা থানায় কোনো মামলা বা জব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে, পুরো চালানটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ওই ইয়াবার চালানটি ছিল উখিয়ার রত্নাপালংয়ের ‘ইয়াবা গডফাদার’ ইকবালের। জব্দ করা ইয়াবা লে. কর্নেল ফারুখ গোপনে ঘুমধুম এলাকার ইলিয়াস মাঝি নামে এক মাদক কারবারির মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়েছেন।
‘এটা কিন্তু খাবার, এটা অবৈধ না’ : যুগান্তরের হাতে আসা আরেকটি অডিওতে ফারুখকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন পণ্য পাচার বিষয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায়। তিনি বলেন, সীমান্তে আমাদের লোকজন মাথায় করে বস্তা পার করছে। প্রতি মাথায় ৬ হাজার টাকা। এটা কিন্তু খাবার, এটা অবৈধ না।
অভিযোগ আছে ফারুখের নির্দেশে ৩৪ বিজিবির টহল টিমের কিছু সদস্যের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব পণ্য সীমান্ত পার করে মিয়ানমারে পৌঁছে দেওয়া হয়। পণ্যপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কমিশন আদায় করা হয়। সেই কমিশনের অন্তত ৫০ শতাংশ ফারুখের পকেটে যায়। বাকি অংশ যায় সংশ্লিষ্ট টহল দলের সদস্য ও স্থানীয় সিন্ডিকেটের হাতে।
আরও যত গুরুতর অভিযোগ : লে. কর্নেল ফারুখের বিরুদ্ধে ইয়াবা ভাগাভাগি, পাচারকারীকে ছাড়, ঘুস আদায় ও নাটকীয় অভিযান সাজানোর একাধিক অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ৮ মার্চ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ পাচারকারী আটক করে ৪ লাখ টাকায় মুক্তি দেওয়া হয়। মামলা হয় ৫০ হাজার পিস দিয়ে। এছাড়া ১৭ মার্চ ৭০ হাজার ইয়াবা জব্দ করে ৩০ হাজার গায়েব করা হয়। ২৫ মার্চ ৫০ হাজার ইয়াবাসহ পাচারকারী আটক, মামলা মাত্র ১০ হাজার পিসের। ২৬ ফেব্রুয়ারি ৩০ হাজার ইয়াবাসহ পাচারকারী আটক, ২ লাখ টাকায় মুক্তি ও ২০ হাজার বিক্রি। ২০ ফেব্রুয়ারি ৫০ হাজার ইয়াবা জব্দ, ৩০ হাজার বিক্রি করে ২০ হাজার দিয়ে মামলা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ঘুমধুমের ব্যবসায়ী জামালসহ তিনজনকে তুলে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে ফারুখের বিরুদ্ধে। জামাল জানান, ফারুখ নিজ হাতেই তাকে মারধর করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিজিবি হেডকোয়ার্টার ও গোয়েন্দা সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
কঠোর ব্যবস্থা নিতে গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ : লে. কর্নেল ফারুখের বিষয়ে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তিনি বলেন, ফারুখকে অতীতে অন্তত দুবার সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও তার কর্মকাণ্ড থামেনি, বরং অপরাধের মাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফারুখ শুধু ইয়াবা কারবারের মতো জঘন্য অপরাধেই জড়িত নন, তিনি সীমান্তে চোরাচালানের সহযোগিতাও করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লে. কর্নেল ফারুখ হোসেন খান যুগান্তরকে বলেন, অডিও দুটি আমার, এটা আমি স্বীকার করছি। তবে ইয়াবা ভাগাভাগিসংক্রান্ত অডিওটি ছিল কৌশলগত। অভিযানের পর কোনো সোর্সকে ইয়াবা দেওয়া হয় না। যে কথোপকথনটি প্রচার হয়েছে, সেই চালানটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
ফারুখ আরও বলেন, কয়েকজন সোর্স এবং ইয়াবা কারবারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কারণেই এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। তাদের কারণে এত অল্প সময়ে বিতর্কিত হয়েছেন বলে দাবি তার। তিনি বলেন, তাদের কারণেই আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চলছে। এদিকে মাথায় করে মালামাল পাচারসংক্রান্ত অডিওর কথোপকথন স্বীকার করলেও তিনি তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
নিজের গাড়িতে মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে ইয়াবা পরিবহণের অভিযোগ বিষয়ে ফারুখ বলেন, এটা সম্পূর্ণ অসত্য। আমার গাড়িতে আমি আর ড্রাইভার ছাড়া কেউ ওঠে না। বিভিন্ন অভিযানে ইয়াবা নয়ছয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অভিযানের সময় আমাদের সঙ্গে অনেক সদস্য থাকেন। চাইলে তাদের কাছ থেকেও বিষয়টি যাচাই করে নিতে পারেন।
ঘুমধুমের তিন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আংশিক স্বীকার করে ফারুখ বলেন, মাঝে মাঝে সীমান্ত এলাকায় কিছু লোককে একটু চাপে রাখা লাগে, যাতে তারা মাদক বা চোরাচালানের সঙ্গে জড়াতে না পারে। তাদের সন্দেহ হলে আমার লোকজন হয়তো কয়েকটা বেতের আঘাত করেছে।
কক্সবাজারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএম ইমরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, লে. কর্নেল ফারুখের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাকে কেউ কখনো অভিযোগ করেননি। এটাই প্রথম, আপনার মাধ্যমে কিছু অভিযোগ জানতে পারলাম। কেউ যদি আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতেন, আমি খুশি হতাম এবং অবশ্যই তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম।
তিনি আরও বলেন, বিজিবিতে অপরাধী যেই হোক না কেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যত বড় পদমর্যাদার কর্মকর্তাই হোক না কেন, কেউ অপরাধ করলে শাস্তির আওতায় আসবে।