পিয়াজ সিন্ডিকেটের পকেটে দেড় হাজার কোটি টাকা

onion peaz

গত দুই মাসে পিয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এতে পণ্যটির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। বাড়তে বাড়তে পিয়াজের দাম ২৬০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এভাবে দফায় দফায় পিয়াজের দাম বাড়িয়ে গত দুই মাসে ভোক্তার পকেট থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী। এ সময়ে ৮ দফা দাম ওঠা-নামা করেছে।

সূত্র অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রতি কেজি পিয়াজের আমদানি মূল্য ছিল ৩০ থেকে ৩৩ টাকা। ভারত পিয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়ানোর ফলে এর দাম আরো বেড়ে ৭০ টাকায় ওঠে। এদিকে ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি কেজির খরচ পড়ে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা।

ওইসব পিয়াজ ওই দুই মাসে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা দরে। এভাবে বাড়তি মুনাফা করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা গত দুই মাসে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভোক্তার পকেট থেকে।

প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে পিয়াজ আমদানি হয়েছে ৯৯ হাজার ১৮৩ টন। আর এসব পিয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ইনভয়েস মূল্য ধরা হয়েছে ৪৯৬.৬৩ কোটি টাকা। ইনভয়েস অনুসারে, সর্বনিম্ন পিয়াজের কেজি ৩৪ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে দাম ১২০ টাকায়। এখানে কেজিতেই দ্বিগুন লাভ করা হয়েছে।

পিয়াজের দাম বাড়ার পিছনে রয়েছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি। মিয়ানমার থেকে যেই পিয়াজ আমদানি হচ্ছে ৪২ টাকায়, ভোক্তা পর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজিতে।

অভিযোগ দামের এই কারসাজিতে জড়িত আমাদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আড়তদাররা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানেও বাড়তি দাম নেয়ার তথ্য উঠে এসেছে।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে অভিযানে দেখা গেছে, মেসার্স রিতা মুক্তা বাণিজ্যালয়ে পিয়াজের ক্রয় রসিদ দেখতে চাওয়া হয়। রসিদে ক্রয় মূল্য লেখা ১৩৭ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করছে ২২০ টাকা। অর্থাৎ পাইকারিতে কেজিতে লাভ করছে ৮৩ টাকা, যা দেখে অবাক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি টিম।

অভিযান পরিচালনাকারী অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় রসিদের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ই নভেম্বর ১৩৭ টাকা কেজি এবং ১৪ই নভেম্বর ১৫৫ টাকা কেজি মূল্যে ক্রয় করে স্টক করেছে, যা সেই পিয়াজ বিক্রি করছে কেজি ২২৯ টাকা। ১৩৭ টাকায় কেনা পিয়াজের ক্রয় মূল্যের সঙ্গে খরচ পরিবহন ভাড়া যোগ করলে সর্বোচ্চ মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ২২০ টাকা বিক্রি করছে।

অন্যদিকে কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির মতে, গত ২লা জুলাই থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত ভোক্তার ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ সময়ের মধ্যে ২৪ বার দাম ওঠানামা করেছে।

সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, ১লা জুলাই পিয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা। ঈদুল আজহা সামনে রেখে একদিনের (২লা জুলাই) ব্যবধানে কেজিপ্রতি বেড়ে যায় ১৫ টাকা। এরপর থেকে নানা অজুহাতে বাড়তে থাকে দাম। হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ টন পিয়াজ আসছে। যার ক্রয়মূল্য কেজিপ্রতি ২৬ থেকে ৪২ টাকা, গড়ে ৩৪ টাকা। সে হিসাবে বিদেশি পিয়াজের বিক্রয় মূল্য ৫০ টাকার বেশি হওয়া অস্বাভাবিক। কিন্তু খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। ৪ মাসের মধ্যে শুধু জুলাই মাসে ৩৯৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। আগস্টে ৪৯১ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সেপ্টেম্বরে ৮২৫ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, অক্টোবরে ১৪০০ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। গত চার মাসে মূল্য বেড়েছে ৪০০ গুণ। এতে ভোক্তার ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, সিন্ডিকেটের কারণে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত দুই মাসের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত জুলাই-আগস্টের শুরুতে প্রতি কেজির দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এর পর থেকেই এর দাম বাড়তে থাকে। ১২ই সেপ্টেম্বর দেশের বাজারে পিয়াজ বিক্রি হয় ৫০-৫৫ টাকা কেজি। ভারত ১৩ই সেপ্টেম্বর পিয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার করার পর এর দাম হু-হু করে বেড়ে যায়। এই খবরে সেদিন দেশের খুচরা বাজারে ২৫-৩০ টাকা বাড়িয়ে দেশি পিয়াজ বিক্রি হয় ৮০ টাকা। এই দরে পিয়াজ বিক্রি হয় ২৩শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে দাম আরো লাফিয়ে বাড়তে থাকে। দাম বেড়ে ওঠে ১২০ টাকায়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশে প্রতি বছর পিয়াজের চাহিদা থাকে ২৪ লাখ টন। সে হিসেবে ১ মাসের চাহিদা ২ লাখ টন। একদিনে চাহিদা ৬ হাজার ৬৬৬ টন। এ হিসাবে একদিনে ৩০ টাকা বাড়ানো হলে ১১ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে কাটা হয়েছে ২১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

২৪শে সেপ্টেম্বর সংকটের কথা জানিয়ে নতুন করে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেশি পিয়াজ বিক্রি হয় ৮৫ টাকায়। যা দুই দিন ধরে বিক্রি হয়। এ দুই দিনে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এরপর ২৬শে সেপ্টেম্বর আরো ৫ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা বিক্রি করে শুরু করে সিন্ডিকেট। ২৯শে সেপ্টেম্বর বিকাল পর্যন্ত ওই দরে বিক্রি করা হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক বিক্রির হিসাব অনুযায়ী, এ সময়ে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ টন পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ওই দরে। এতে ভোক্তার পকেট থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে ১০৬ কোটি টাকা।

ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে ২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এক লাফে পিয়াজের দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। ১লা অক্টোবর পর্যন্ত সেটি অব্যাহত ছিল। আরো দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ওই সময়ে ভোক্তারা সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে পিয়াজ কিনেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ৮ হাজার টন পিয়াজ বিক্রি হয়েছে। ১লা অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে এতে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ চার ধাপে ভোক্তার পকেট থেকে ন্যূনতম ৫৭২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

এভাবে পিয়াজের বাজার ওঠা-নামার পর ২রা নভেম্বর কেজিতে ১০-১৫ টাকা কমে পিয়াজের দর হয় ১১০-১২০ টাকা। যা ৮ই নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দাম কমার পরও সিন্ডিকেট কেজিতে ৬০-৭০ টাকা অতি মুনাফা করে। সে অনুযায়ী এই ৭ দিন ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় ৩২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ৯ই নভেম্বর কেজিতে ১০ টাকা কমে পিয়াজের দর হয় ১০০-১১০ টাকা। যা ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দাম কমার পরও সিন্ডিকেট কেজিতে ৫০-৫৫ টাকা অতি মুনাফা করে। সে অনুযায়ী এই ৪ দিন ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় আরো ১৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

তীব্র সংকটের কথা বলে ১৩ই নভেম্বর এক লাফে পিয়াজের দর কেজিতে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০-১৬০ টাকা। সে অনুযায়ী একদিনে ভোক্তার পকেট থেকে ৭৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। ১৪ই নভেম্বর দিনের শুরুতে ১৬০-১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যা দিন শেষে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজির দাম সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় ওঠে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক বিক্রির হিসাব অনুযায়ী, এ সময়ে ১১০ কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়।

পরের দিন ১৫ই নভেম্বর আরো এক দফা বাড়ে পিয়াজের দাম। সেদিন প্রতি কেজি পিয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ২৫০ টাকা। যা ১৬ই নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সে অনুযায়ী এই দুই দিনে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ২৬৬ কেটি ৬৬ লাখ টাকা। এর পর পিয়াজের দাম পাইকারিতে কমতে কমতে ১৬০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের অবরোধের অজুহাতে গতকাল আবারও কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত দুই মাসে ৮ ধাপে ১৫০০ কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু চক্রটি।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্যের ওঠানামা বাজারের ধর্ম। তবে দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। তারা একবার দাম বাড়ালে আর কমান না। তার মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর নেই। ফলে সিন্ডিকেট ধরা যাচ্ছে না। সূত্র: মানবজমিন