জীবনে আমরা কখনো এমন অবস্থা দেখিনি : ইতালির চিকিৎসকের বয়ান

আমি ইতালির একজন চিকিৎসক। কিন্তু আমি ও আমার সহকর্মীদের কেউ কখনো এমন সংকটময় অবস্থা দেখিনি। আমরা ভালো করেই জানি কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া এমনকি ভূমিকম্পের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাস এখানে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রতিদিন অবস্থা পূর্বের দিনের তুলনায় আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আমরা কি এই অবস্থা সামাল দিতে পারছি? উত্তর হচ্ছে, না।

মহামারি বিষয়টা আমাদের কাছে এমন যে, আমরা সবসময় ভাবি এটা পৃথিবীর অপর প্রান্তে ইউরোপ থেকে অনেক দূরে সংক্রমিত হতে পারে। এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে কুসংস্কারের মতো গেঁথে গিয়েছিল।

কিন্তু এবার এই মহামারি একদম আমাদের শহরে হানা দিয়েছে। আমরা যাদেরকে ভালোবাসি, যারা আমাদের প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মী তাদের জীবন কেড়ে নিয়েছে।

ইউরোপের করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র ইতালির প্রদেশ লোমবার্ডি। আমি সেখানকার একটি হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়াবিদ। গত ২১শে ফেব্রুয়ারি ইতালিতে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। আমাদের হাসপাতাল মূলত কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ক। তবে আমরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যেসব রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সাহায্য করতে আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থা নেবে। অন্য হাসপাতালগুলোর সঙ্গে মিলে আমরা একটি টাস্কফোর্স গঠন করলাম। যাতে করোনা ভাইরাসের অবস্থা যত খারাপই হোক আমরা প্রস্তুত থাকতে পারি।

আমাদের সার্জারির সকল শিডিউল বাতিল করা হলো। ইনটেনসিভ কেয়ারের বেডগুলো করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হলো। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতাল নতুন ইনটেনসিভ কেয়ার খুলতে শুরু করলো। এ জন্য সাধারণ অপারেশন থিয়েটার ও অ্যানেসথেটিক কক্ষগুলোকে পরিবর্তন করা হয়। এ ছাড়া, করোনা আক্রান্তের জন্য আরো ৪০টি বেড ছেড়ে দেয়া হয়।

কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় এটি ছিল একেবারেই অপ্রতুল। মঙ্গলবার নাগাদ ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২০০০। এরমধ্যে মারা গেছেন ২৫০৩ জন আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২৯৪১ জন। ইতালিতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছে লোমবার্ডি প্রদেশ। এখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬২২০ জন। মারা গেছেন ১৬৪০ জন। ইনটেনসিভ কেয়ারে আছেন ৮৭৯ জন। আমি আশঙ্কা করছি, ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যাবে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, চিকিৎসকরা বাধ্য হয়েছেন সিদ্ধান্ত নিতে যে কাকে চিকিৎসা দেবেন আর কাকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রাখবেন। যদিও আমাদের হাসপাতালে এমন অবস্থা হয়নি। এখানে সব রোগীই তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেয়েছে। তবে ঝুঁকি রয়ে গেছে। কোনোভাবে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু না করে তাহলে পরিস্থিতি দ্রুতই আমাদের ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও সেসব রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে যাদের বেঁচে যাওয়ার সুযোগ অন্যদের থেকে বেশি।
ইতালির চিকিৎসকরা মানবতার জন্য বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করছেন। আমরা জানি যে, দেশের এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কতখানি দরকার। এই ভাবনাটিই আমাদের শক্তি যোগায়, মানসিক ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়। আমি জানি না আর কতদিন এমন ভয়াবহ প্রতিরোধ ধরে রাখতে হবে আমাদের। ইতিমধ্যে, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ইনটেনসিভ কেয়ারে আছেন, মৃত্যুঝুঁকি ব্যাপক।

তারমধ্যেও খুব করে বিশ্বাস করতে চাই যে, এই মহামারির শেষের শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্বাস সত্যি হবে কিনা তা তখনই নিশ্চিত হওয়া যাবে, যখন নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসতে শুরু করবে। হয়তো বিশাল এই কন্টেইনমেন্ট প্রচেষ্টা সফল হবে। হয়তো সপ্তাহ শেষে আমরা ভালো খবর পাবো। কিন্তু এখনকার মতো, আমরা একটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত।