যশোরের কেশবপুর উপজেলার ডালিঝাড়া গ্রামের একটি প্রত্নস্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চলের অফিসের একটি খনন দল একটি পূর্ণাঙ্গ ‘বৌদ্ধ-বিহার-মন্দির কমপ্লেক্স’ আবিষ্কার করেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই স্থাপনাগুলো আনুমানিক খ্রি. ৯ম থেকে ১১ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সহ ভারতের পশ্চিমবাংলার সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলে এমন স্থাপনা প্রথম আবিষ্কৃত হলো। দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে এই স্থাপনাগুলোর এমন কিছু অনন্য ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত অন্যান্য বৌদ্ধবিহারগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন ও আলাদা।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যিক এই বৈশিষ্ট্যাবলির বিবেচনায় এই ‘বৌদ্ধ বিহার-মন্দির কমপ্লেক্স’-এর ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশ ও ভারতের বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবাংলার সমসাময়িক অন্যান্য বৌদ্ধস্থাপনা থেকে আলাদা। অধিদপ্তরের গবেষকগণ এবং তাদের অনুরোধে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে এমন বৈশিষ্ট্যাবলি সম্পন্ন বৌদ্ধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে কীনা তা বোঝার ও জানার চেষ্টা করছেন।
এই ব্যতিক্রমী, অনন্য ও বিরল ‘বৌদ্ধবিহার-মন্দির’ স্থাপনাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির বিস্তার ও পরিবর্তন এবং ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কেশবপুর উপজেলার ডালিঝাড়া ঢিবিতে খনন শুরু করেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব জনাব মো: হান্নান মিয়ার অনুমোদনক্রমে, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক জনাব আফরোজা খান মিতার সার্বিক তত্ত্বাবধানে খনন পরিচালনা করেছেন আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন টিমের অন্যান্য সদস্যরা হলেন, গবেষণা সহকারী উর্মিলা হাসনাত, মার্কসম্যান মো: রিপন মিয়া, প্রাক্তন সিনিয়র ড্রাফটসম্যান মো. জাহান্দার আলী ও প্রাক্তন আলোকচিত্রকর মো. আবদুস সামাদ।
খনন কাজে মহাস্থানগড় বগুড়া হতে আগত দক্ষ খনন শ্রমিক ও স্থানীয় শ্রমিকের দ্বারা খনন কার্যক্রম চলছে।
স্থাপনাটির সামগ্রিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশের অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার/মহাবিহারগুলোর মূল স্থাপত্যিক পরিকল্পনাই অনুসৃত হয়েছে। যদিও উত্তর দিকের ভিক্ষুকক্ষসহ বাহুটি এখনো উন্মোচিত হয়নি। এক্ষেত্রে তিনদিকে ভিক্ষকক্ষ ও একদিকে মন্দির সহ একটি আয়তাকার পরিকল্পনা অনুসৃত হয়েছে। মাঝখানে রয়েছে বিহারের অঙ্গন।
বিহারাঙ্গনের মধ্যেও অন্যান্য স্থাপনা থাকতে পারে, যেমন অন্যান্য বিভিন্ন বিহারে রয়েছে। প্রাপ্ত মৃৎপাত্র এবং স্থাপত্য শৈলিগত বিবেচনায় এই বিহারটির সময়কাল আনুমানিক ৯ম- ১১শ শতক।
বৌদ্ধবিহার খনন সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, গত ২২ জানুয়ারী ২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখ থেকে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়েছে। খননের ফলে আনুমানিক ৯ম- ১১শ শতকের একটি বৌদ্ধ বিহার উন্মোচিত হয়েছে। বিহারের পূর্বদিকে দুটো বৌদ্ধ মন্দির এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে টানা বারান্দা, ভেতরের ও বাইরের দিকে দেওয়ালসহ সর্বমোট ১৮টি কক্ষ উন্মোচিত হয়েছে। বিস্তৃত খনন করা সম্ভব হলে আরো স্থাপত্যিক কাঠামোর উন্মোচন হবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক কার্যালয় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, রিচার্ড এটনের জনপ্রিয় তত্ত্ব এবং প্রচলিত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের ইতিহাস সুলতানি যুগের পূর্বে নয়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনা এর সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতসমুহ এই অঞ্চলের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা আদিমধ্য যুগ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে আদিমধ্যযুগীয় বসতির আলামতের হিসেবে এটি আরো একটি নতুন এবং অনন্য সংযোজন। ইতিপূর্বে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত সবগুলো স্থাপত্য কাঠামোই আদিমধ্য যুগীয় বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপ। এবছর ডালিঝাড়া ঢিবিতে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে একটি বৌদ্ধ সংঘারাম বা বিহারের স্থাপত্য কাঠামো পাওয়া গিয়েছে। এটি দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায় আদিমধ্য যুগের বসতিরই প্রমাণক।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন টিমের সদস্য গবেষণা সহকারী উর্মিলা হাসনাত বলেন যে, খননের ফলে অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির ফলকের ভগ্নাংশ ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির ইট ও ফলকের ভগ্নাংশগুলোতে পদ্মফুল ও বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা অংকিত রয়েছে। এছাড়াও চুন সুরকি, বালি দ্বারা নির্মিত স্টাকো পাওয়া যায়। স্টাকোগুলোতে নানাধরণের ফুলেল ও জ্যামিতিক নকশা পাওয়া গেছে। এখানে একটি বিশেষ ধরণের বাটি আকৃতির মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে যা সাধারণত ৭ম-১১শ শতকের বৌদ্ধবিহারসহ অন্যান্য প্রত্নস্থানে পাওয়া যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, স্থাপনাটির পূর্বদিকের অংশ ঢিবি আকারে ছিল। তবে খননের ফলে উন্মোচিত স্থাপনার বিস্তার উত্তর ও পশ্চিমের বর্তমান কৃষিজমির মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। এখনো নতুন নতুন দেয়ালের অংশ ও ফিচার উন্মোচিত হচ্ছে।
স্থাপনাটিকে প্রাথমিক পর্যালোচনায় তিনটি মন্দির বিশিষ্ট একটি বৌদ্ধ বিহার বলে আমি শনাক্ত করতে চাই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ সহজ না হওয়ার কারণ হলো বিহারটির স্থাপত্যিক পরিকল্পনায় অন্যান্য বিহারের চাইতে ভিন্নতা রয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে বর্তমান বিহার, উড়িষ্যা এবং পশ্চিম বাংলায় আর বাংলাদেশে অদ্যাবধি যে সব বৌদ্ধ বিহার বা মহাবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব বিহার/মহাবিহারের সঙ্গে এই ভূমিপরিকল্পনার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
তিনি বলেন, সাধারণত বৌদ্ধ বিহারগুলোর চতুষ্কোণাকার হয় (আয়তাকার বা বর্গাকার)। চারদিকে চারটি বাহুতে ভিক্ষুকক্ষ, ছোট মন্দির/চৈত্য থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদিকের বাহুতে মন্দির থাকে এক বা একাধিক। কক্ষগুলোর সামনের দিকে লম্বালম্বি বারান্দা থাকে। মাঝখানে বিহারাঙ্গন বা কোর্টইয়ার্ড থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিহারাঙ্গনে একটি বা একাধিক মন্দির, নিবেদন স্তূপসহ নানা ধরনের স্থাপনা থাকে (ঠিক যেমন রয়েছে পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে, কিংবা কুমিল্লার শালবন বিহারে)। কুমিল্লার রূপবান মূড়া বা ইটাখোলা মুড়া, ভোজ বিহারের ভূমি পরিকল্পনায় যেমন ভিন্নতা রয়েছে তেমনই সাদৃশ্যও রয়েছে। দিনাজপুরের সীতাকোট বিহার, অরুণ ধাপের বিহার বা দোমাইলের বিহারগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের বিহার। বগুড়ার মহাস্থানের ভাসুবিহারের বিহারগুলোও ছোট আকারের। বিহারের নালন্দা মহাবিহারে ছোট ছোট বিহারের একটি গুচ্ছ রয়েছে। আবার, নওগার জগদ্দল (মহা) বিহার, পশ্চিম বাংলার জগজ্জীবনপুরের নন্দদীর্ঘিকা মহাবিহার বা সম্প্রতি বিহারের লক্ষ্মসরাইয়ে উন্মোচিত বিহার/মহাবিহারগুলোতে বর্গাকার বা আয়তাকার কাঠামোর প্রতিকোণে একটি করে বৃত্তাকার কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষগুলো বিশেষ কাজে তৈরি হয়েছিল বলেই অনুমান করা হয়। অন্যদিকে, বিহারের আনতিচকে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার (যেটিকে অনেকেই বিক্রমশীলা মহাবিহার বলে ধারণা করেন) পূর্বভারতে সবচাইতে বড় বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের অঙ্গনে একটি কেন্দ্রীয় ক্রশাকৃতি মন্দির (সোমপুর মহাবিহার বা শালবন বিহারের মতন) রয়েছে। কিন্তু বিহারের বাহুর ভিক্ষু কক্ষগুলো দুই সারিতে বিন্যস্ত। পিছনে গোলাকার/অর্ধগোলাকার ও সামনে বর্গাকার কক্ষ এখানে রয়েছে।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, উড়িষ্যার রত্নগিরি, উদয়গিরি এবং ললিতগিরির বৌদ্ধবিহারের গুচ্ছগুলোর স্থাপত্যিক পরিকল্পনা বিহার বা মহাবিহারের মৌলিক গঠন অনুসরণ করেই করা হয়েছে, ঈষৎ ভিন্নতাসমেত।
তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানের আদি মধ্যযুগের (খ্রি. ৭ম-৮ম শতক থেকে শুরু করে ১২শ-১৩শ শতক অব্দি) ইট নির্মিত বৌদ্ধবিহারগুলোর গঠনে, স্থাপত্য পরিকল্পনায় এবং মৌলিক কাঠামোগত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এর আগের বৌদ্ধবিহারগুলোর ক্ষেত্রেও যেমন (বিহারের সারনাথ বা উত্তর প্রদেশের শ্রাবস্তী) বিহারগুলো ইট নির্মিত এবং এই মৌলিক ভূমিপরিকল্পনা অনুসৃত হয়েছে। আদি ঐতিহাসিক যুগের রককাট বিহারগুলোর ক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পনাগত ভিন্নতা রয়েছে। দক্ষিণ ভারতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে পাথরের ব্যবহার হলেও একটি বর্গাকার বা আয়তাকার পরিকল্পনা এবং চারপাশে ভিক্ষুকক্ষ ও মন্দির/চৈত্যসহ বিহারের ভিতরে ও বাইরে ছোট মন্দির, নিবেদন ও শারিরীক স্তূপ, বড় আকারের স্তূপসহ নানান ধরনের সন্নিবেশ পরিলক্ষিত হয়।
বিহার স্থাপত্য যেমন বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে তেমনই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পনাগত ক্ষেত্রে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিহার স্থাপত্য প্রসঙ্গে নানা ধরনের গবেষণা ও প্রকাশনা সহজলভ্য। এমনকি বিভিন্ন বিহার/মহাবিহারের ভূমিপরিকল্পনাও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, স্থাপনাটির সামগ্রিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশের অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার/মহাবিহারগুলোর মূল স্থাপত্যিক পরিকল্পনাই অনুসৃত হয়েছে, যদিও উত্তর দিকের ভিক্ষুকক্ষসহ বাহুটি এখনো উন্মোচিত হয় নাই। বিহারাঙ্গনের মধ্যেও অন্যান্য স্থাপনা থাকতে পারে যেমন অন্যান্য বিভিন্ন বিহারে রয়েছে। প্রাপ্ত মৃৎপাত্র এবং স্থাপত্য শৈলিগত বিবেচনায় এই বিহারটির সময়কাল আনুমানিক ৯ম- ১১শ শতক।
এই বৌদ্ধ বিহারের ব্যতিক্রমী ও অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলি হলো :
১. ভিক্ষুকক্ষগুলো একটি অন্যটি থেকে একটি মেঝেবিশিষ্ট পরিসরের মাধ্যমে আলাদা। সাধারণত অন্যান্য বিহারগুলোতে ভিক্ষকক্ষগুলো একটি দেয়ালের মাধ্যমে পরস্পর থেকে পৃথক থাকে। একটি তুলনামূলকভাবে প্রশস্ত পরিসরের মাধ্যমে পরস্পর থেকে পৃথক ভিক্ষুকক্ষ আমি যতগুলো বিহার সরেজমিনে দেখেছি এবং যতগুলো বিহারের ভূমিপরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট খনন ও গবেষণা প্রতিবেদন পড়েছি সেগুলোতে দৃশ্যমান না।
২. এই বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম কোণায় কোনো কক্ষ নাই। তার বদলে এই পরিসরটি ইটবাঁধানো বা মাটি-ইটের গুড়া পিটিয়ে নির্মিত (র্যামড) মেঝেবিশিষ্ট।
৩. ভিক্ষু কক্ষগুলোর প্রবেশদ্বারের দিকের বারান্দার পাশাপাশি পিছনেও একটি প্রশস্ত বারান্দা বা বারান্দা সদৃশ পরিসর রয়েছে। এই বারান্দাদুটো ভিক্ষকক্ষগুলোকে পৃথককারী পরিসরদ্বারা যুক্ত এবং উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার মেঝের সঙ্গে যুক্ত।
৪. বিহারটির পূর্ব বাহুতে কোনো ভিক্ষুকক্ষ নাই। এখানে দুটি সেলুলার স্থাপনারীতিতে নির্মিত মন্দির রয়েছে। বিহারের স্থাপনাটি আকরের প্রতিসমতা ও গঠন আমলে নিলে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আরেকটি মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে স্থানীয় মানুষজন বাড়ি নির্মাণ করে এই মন্দিরটির উপরের কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছে।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, এর আগে উদাহরণ হিসেবে উল্লিখিত ভারত ও বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহারগুলোর বেশিরভাগই সরেজমিনে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নিজের গবেষণার প্রয়োজনেই আমি এগুলো দেখেছি এবং বৌদ্ধ স্থাপত্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন গবেষকদের সঙ্গে আলাপআলোচনা করেছি।
আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বলতে পারি যে, নির্দিষ্ট পরিসর দ্বারা পৃথকীকৃত ভিক্ষুকক্ষবিশিষ্ট, সেলুলার স্থাপনারীতিতে নির্মিত তিনটি মন্দির বিশিষ্ট এবং বিহারের বাহুর ভিতরের ও বাইরের দিকে (ভিক্ষুকক্ষের সামনে ও পিছনে) বারান্দা বিশিষ্ট কোনো বৌদ্ধবিহার আমার জানামতে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশে খুঁজে পাওয়া যায় নাই।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, এই অনন্য বিহারটির গুরুত্ব বেড়ে যায় আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের পশ্চিমবাংলার দক্ষিণাংশ একই ধরণের ভূমিরূপ দ্বারা বৈশিষ্ট্যময়। নদীবহুল, সতত পরিবর্তনশীল এবং সমুদ্র উপকূলের সন্নিকটস্থ জোয়ারভাটার প্রভাববলয়ের অন্তর্ভুক্ত এই ভূমিরূপের বয়স তুলনামূলকভাবে নবীন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, নদীভাঙ্গন, নদীর গতিপথের সতত পরিবর্তন, জোয়ারে নিমজ্জিত হওয়া, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি) এই অঞ্চলকে ঐতিহাসিকভাবেই প্রভাবিত করে আসছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এই ভূভাগে পশ্চিমবাংলায় প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূপ্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বেশি হয়েছে। সেখানে আদি ঐতিহাসিক যুগ থেকেই এই ভূভাগে মানববসতির বিভিন্ন আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সংলগ্ন ভূভাগে কয়েকটি আদি-মধ্যযুগীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বাদ দিলে মূলত সুলতানী ও মোগল আমলের স্থাপত্যিক নিদর্শনই বেশি পাওয়া গেছে। গত কয়েকবছরের নানামুখী গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সুন্দরবনসহ সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ও প্রাক-মধ্যযুগীয় বসতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
আবিষ্কৃত এই বৌদ্ধ বিহার অবিভক্ত বাংলার দক্ষিণবঙ্গে আবিষ্কৃত প্রথম সম্পূর্ণ ও তিনটি মন্দির বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহার।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, এর আগে মাগুরার ভাতভিটায় একটি বিহারের সাতটি কক্ষ আবিষ্কারের দাবি প্রকাশিত হয়েছে। স্থাপত্য পরিকল্পনাগত ভিন্নতা, ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য এবং ভূমিরূপের সঙ্গে উপযোগী স্থাপত্য-কৌশল ব্যবহার করে নির্মিত এই অনন্য বৌদ্ধবিহার-মন্দির কমপ্লেক্স বাংলাদেশের তথা উপমহাদেশের প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে নতুন ও অভিনব সংযোজন।
তিনি বলেন, বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করলে যশোরের মণিরামপুর থেকে সাতক্ষিরার শ্যামনগর পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের উপত্যকার পূর্বাংশে এবং ভদ্রা-হরিনদীর পশ্চিমাংশে অনেকগুলো প্রত্নস্থান অবস্থিত। আমার ধারণা নিবিড় জরিপ পরিচালনা করা হলে এই অঞ্চল এবং আরো দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত আরো অনেক প্রত্নস্থান পাওয়া যাবে। এই প্রত্নস্থানগুলোতে যেমন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের বসতির সাক্ষ্য হিসেবে মৃৎপাত্রর টুকরা, কড়ি (ওই সময়ের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত)সহ নানান ধরনের প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। ভরতভয়নার ক্রশাকৃতি বা সর্বোতভদ্র ধরনের বৌদ্ধ মন্দির, মনিরামপুরের দমদম পীরস্থান ঢিবির বৌদ্ধ মন্দির, ঝুড়িঝাড়ার বৌদ্ধ মন্দিরগুলো খননে উন্মোচিত হওয়ায় আমরা সেগুলোরে প্রকৃতি সম্পর্কে জানি।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, কপিলমুণির বিস্তৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর প্রকৃতি বুঝতে হলে এখানে আরো নিবিড় জরিপ ও খনন পরিচালনা করতে হবে। শ্যামনগর ও তালার প্রত্নস্থানগুলোর প্রকৃতি বা সুন্দরবনের মধ্যকার প্রত্নস্থানগুলোর প্রকৃতি ও বিস্তৃতি বুঝতে গেলে নিবিড় জরিপ, মানচিত্র তৈরি করা এবং কয়েকটি নির্বাচিত স্থানে খনন পরিচালনা করতে হবে।
তিনি বলেন, এখনো অব্দি যে নিদর্শনগুলার কথা আমরা জানতে পারি সেগুলোর অবস্থান ও বিস্তার বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় আমরা ধারণা করতে পারি:
প্রথমত, এই বৌদ্ধ মন্দির, বিহারসহ স্থাপনার ধ্বসাবশেষগুলো এই অঞ্চলে মানববসতির সঙ্গে সম্পর্কিত। মানববসতিগুলো এই স্থাপনাগুলোকে কেন্দ্র করেই বা স্থাপনাগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক রেখেই এখানে গড়ে উঠেছিল, বিকশিত হয়েছিল। সেগুলোর বিস্তৃতি অনেকক্ষেত্রে সমসাময়িক নগরগুলোর চেয়েও বড় এলাকা জুড়ে ছিল। তার অর্থ এই না যে, এই বসতিগুলো নগরই ছিল। তবে গ্রাম বা বাণিজ্য-যোগাযোগ-প্রশাসননিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই বসতিগুলোর যোগাযোগ ছিল।
দ্বিতীয়ত, ইদানিং সমুদ্রপথে বাণিজ্য নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বর্তমান ভারতের পূর্বউপকূল, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, চট্টগ্রামের উপকূল হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থান হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও চীনের ইউনানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধ ধর্মীয় ভিক্ষু/পরিব্রাজকদের যোগাযোগের নতুন নতুন তথ্যাদি গবেষণায় সামনে আসছে। তানসেন সেন বা বাগুয়াই ওয়েইং কিংবা বেন ইয়াংয়ের মতোন গবেষকগণ বৌদ্ধ ধর্ম, বাণিজ্য এবং কূটনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করছেন।
কপিলমুণি থেকে প্রচুর পরিমানে কড়ি পাওয়া গেছে। এই কড়ির উৎস ছিল মালদ্বীপ। বলা হচ্ছে বাংলার এই অঞ্চল থেকে চাল রফতানী করে কড়ি আমদানী করা হতো। সেই কড়ি একদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, অন্যদেকে ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর হয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল অব্দি পাঠানো হতো।
পশ্চিম বাংলার রজত সান্যাল, সুচন্দ্রা ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শর্মী চক্রবর্তী, রিলা মুখোপাধ্যায়, সায়ন্তনী পালদের মত গবেষকগণ, কেনেথ হলসহ নানা গবেষকে বঙ্গোপসাগর মারফত বিভিন্ন দিকে যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সাম্প্রতিক গ্রন্থাদিতে। কড়ি কেন্দ্রীক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক নিয়েও বেন ইয়াংসহ নানাজন কাজ করেছেন। ভূমি ও সমুদ্রপথের যোগাযোগ, উপকূলীয় অঞ্চল ধরে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক, বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য এবং সেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবিভক্ত বাংলার দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করেছেন। এই নেটওয়ার্ক খ্রি. ৭ম-৮ম শতক থেকে সক্রিয় ছিল ১৮শ শতক অব্দি বা তার পরেও, নানান উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে। আরবীয় বণিকদের বিভিন্ন বিবরণীর উল্লেখও এই গবেষকদের অনেকেই করেছেন। সঞ্জয় সুব্রামনিয়ামের মতন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মধ্যযুগে, বিশেষকরে খ্রি, ১৫শ শতকের পরে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক বিস্তারের কথা বলেছেন। আমাদের সামনে নানা নতুন নতুন উপাত্ত ও তথ্য আছে। তবে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির বিস্তার, সেই বসতির সঙ্গে এখানে কৃষিকাজ ও আবাদী জমির বিস্তার, এখানকার নদীগুলো হয়ে সমুদ্রর মাধ্যমে ভারতের ও ভারতের বাইরে অন্যান্য স্থানের বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের জন্য যে ধরনের তথ্য ও উপাত্ত দরকার তা এখনো আমাদের কাছে নাই। গবেষনার অভাবে।
উপকূলীয় অঞ্চলসহ এতদঅঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থান নিয়ে নিবিড়, দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা তাই আমাদের সামনে স্থানীয় ও দুনিয়ার মধ্যকার বিভিন্নমাত্রিক যোগাযোগের প্রকৃতি, কারণ ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত ও তথ্য সরবরাহ করতে পারে। লিখিত উৎস নির্ভর বিবরণী ও ব্যাখ্যাকে প্রশ্ন করতে পারে, পরিমার্জন করতে পারে, নতুন ব্যাখ্যা যুক্ত করতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকে তাই অবজ্ঞা করার সুযোগ নাই।
তৃতীয়ত, এখানে মানুষ খ্রি. ৭ম শতকের পর থেকেই বহু সংখ্যক বসতি গড়ে তুলেছিল। সেই বসতি তৈরি করার ক্ষেত্রে এধরনের ধর্মীয় স্থাপনা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল সম্ভবত। এমনকি, বিভিন্ন নতুন গবেষণায় দেখা যায়, বৌদ্ধ বিহারের বৌদ্ধ সঙ্ঘগুলো কৃষিকাজ, আবাদ, জলব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তাই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এই বসতিগুলোর নানাধরনের কাজ ও ভূমিকা ছিল। নদীপথে, স্থলপথে ও সমুদ্রপথে বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্ততা তৈরি করার ক্ষেত্রে এগুলোর প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। আবাদী জমির বিস্তারের জন্য, শস্য উৎপাদনের জন্য, অন্যান্য ধরনের দ্রব্য উৎপাদন, সরবরাহ, ও ব্যবস্থাপনায় এসব বসতির ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, প্রত্নস্থানটির সামগ্রিক স্তরতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও স্থাপনার অভিনবত্বের কারণ অনুসন্ধান এবং সামগ্রিক সমসাময়িক মানববসতিগুলোর সঙ্গে এই স্থাপনা ও বসতির আন্তঃসম্পর্ক পর্যালোচনার জন্য পুরো বৌদ্ধ স্থাপনাটি উন্মোচন করা জরুরি। পাশাপাশি, উল্লম্বভাবেও স্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট ডিপোজিট-ফিচারগুলোর আন্তঃসম্পর্কগত স্তরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরি। মানববসতি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার, তৎকালীন আন্তঃআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক মানববসতিগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও রূপান্তর বোঝার জন্য এই কাজটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখবে। এখানকার ভূমিরূপ ও নদীব্যবস্থাসহ প্রত্নপরিবেশগত বিশ্লেষণেও এই আবিষ্কার ভূমিকা রাখবে।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন বলেন, দক্ষিণ বঙ্গের মানব বসতির ইতিহাস, গাঙ্গেয় বদ্বীপের ইতিহাস এবং সামগ্রিকভাবে, এখানকার প্রতিবেশের সঙ্গে মানুষের অভিযোজনের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।
প্রখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. অরুণ নাগের বলেন, “সম্প্রতি বাংলাদেশের খুলনা আঞ্চলিক প্রত্নঅধিকর্তা দপ্তর থেকে ডালিঝাড়া ঢিবিতে যে খননকার্য চালানো হয়েছে তার আলোকচিত্র, ভূমি-নকশা ইত্যাদি দেখে আমার দৃঢ় ধারণা এটি একটি বৌদ্ধ বিহার, যার আনুমানিক সময়কাল খ্রি. নবম-দশম শতক। দুটি কারণে এই আবিষ্কারটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, দক্ষিণবঙ্গে ভরত ভায়নার পর এটি দ্বিতীয় বৌদ্ধ বিহার যা আবিষ্কৃত হলো ও এই স্থাপত্যটির কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায়নি। আমি মনে করি সমগ্র স্থাপত্যটি প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের প্রত্নইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটবে”।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা ও মানবিকী অনুষদের বর্তমান ডীন ড. মো. মোজাম্মেল হক মনে করেন, ‘এই স্থাপনার ভূমি পরিকল্পনা একটি ছোট আকারের মন্দিরবিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহার। উন্মোচিত কাঠামোটির আকার ও গঠন তুলনামূলকভাবে পরবর্তী (খ্রি. ১০শ শতক পরবর্তী) প্রবণতা ধারণ করে’।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. হান্নান মিয়া বলেন, যশোরের কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের ডালিঝাড়া ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বৌদ্ধ স্থাপনাটি মুজিববর্ষে আমাদের অন্যতম অর্জন। প্রাচীন এ নিদর্শনটির বিস্তৃত খনন ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ভূমি অধিগ্রহণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
ডালিঝাড়া বৌদ্ধবিহারের অবস্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পটভূমি
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে “ডালিঝাড়া” নামক ঢিবিটি অবস্থিত। প্রসিদ্ধ প্রত্নস্থল ভরত ভায়না বৌদ্ধ মন্দির থেকে আনুমানিক ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এর অবস্থান। চারপাশের ভূমি থেকে ঢিবির পূর্ব অংশ প্রায় ২.৫ মিটার উচুঁ। প্রত্নস্থানটি ইতোমধ্যেই বসতবাড়ি, পানের বরজ, কলাবাগান করার ফলে ঢিবি অনেকাংশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঢিবির মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ইটের টুকরা, মৃৎপাত্র দৃশ্যমাণ।
জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে প্রত্নস্থলটিতে বসবাসকারী মানুষজন দিন দিন এই স্থানটি কেটে ফেলছে। কিছুটা মাটি অপসারণ করলেই বেরিয়ে আসছে ইটের তৈরী প্রাচীন স্থাপত্যিক অবশেষ।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠা-২১২ তে উল্লেখ করেছেন যে “ ভরতের দেউলের অর্ধমাইল দক্ষিণে কাশিমপুর গ্রামে ডালিঝাড়া বলিয়া একটা স্থান আছে। ইহাও একটি ভগ্ন স্তূপ। এখানে ভরত রাজার কোন কর্ম্মচারী বাড়ী থাকিতে পারে”।
স্বনামধন্য প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর “বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ” গ্রন্থে ডালিঝাড়া ঢিবি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। গ্রন্থের ৩৮২ পৃষ্ঠায় ‘গৌরীঘোনা’ নামক স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, “ভরতভায়না থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে গৌরিঘোনা নামক একটি প্রাচীন গ্রাম আছে। এ গ্রামে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ এককালে ছিলো। বর্তমানে( ১৯৭৫খ্রিঃ) গ্রামের এখানে সেখানে প্রাচীন ইট ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা য়ায় না। স্থানীয় লোকেরা এ স্থানকে ভরত রাজার বাড়ি বলে সনাক্ত করেন”।
গ্রন্থের ৩৮৩ পৃষ্ঠায় তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, “ভরত ভায়না স্তুপ ও আশেপাশের ধ্বংসাবশেষগুলি দেখে ধারণা হয় যে, বহু প্রাচীন কালে এ স্থানে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। গৌরীঘোনা গ্রামের ধ্বংসাবশেষগুলিও ছিল খুব সম্ভব কোন বৌদ্ধবিহার বা স্তুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কোনো রাজবাড়ি খুব সম্ভব এটি ছিল না। নিম্নবঙ্গে সমুদ্রের কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত এ সব কীর্তি কত প্রাচীন, খনন না করে সে সম্পর্কে নিশ্চয় করে কিছু বলা কঠিন। তবে ২৪ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড়ে ও বেড়াচাম্পায় খননের ফলে মৌর্য যুগের বহু কীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। ভরতভায়না থেকে সে সব স্থানের দুরত্ব ৬৪ কিলোমিটারের বেশি নয়। ভরতভায়না, আগ্রা-কপিলমুনি, আমাদি প্রভৃতি স্থানের ধ্বংসাবশেষগুলিও সে কালের এবং সে সব কীর্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া বিচিত্র নয়”।
বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যিক বিবরণ
বৌদ্ধ বিহারটি আয়তাকার। পূর্বদিকে ২টি মন্দির, উত্তরবাহুতে ২টি ভিক্ষুকক্ষ, দক্ষিণ বাহুতে ৯ টি ভিক্ষুকক্ষ, পশ্চিম বাহুতে ৭ টি ভিক্ষুকক্ষ রয়েছে। পশ্চিবাহুর মাঝখানে একটি বড়কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষটির পশ্চিমে একটি বৃহৎদাকার অভিক্ষেপ/প্রজেকসন রয়েছে। পশ্চিমবাহুর মধ্যবর্তী এই অভিক্ষেপ ও বড় কক্ষটিই বিহারের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল।
বৌদ্ধবিহারটির পূর্বদিকে দুইটি বৌদ্ধ মন্দির উন্মোচিত হয়েছে। যার মধ্যে উত্তর-পূর্বকোণের মন্দিরটির পরিমাপ হলো উত্তর-দক্ষিণে আনু. ১৯ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আনু. ২৪ মিটার। পূর্বদিকে মাঝ বরাবর (পশ্চিম দিকের বাহুর মধ্যবর্তী প্রবেশদ্বারের ঠিক বিপরীতে) উন্মোচিত বৌদ্ধমন্দিরটির পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে আনু. ২১ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আনু. ২৪ মিটার।
মন্দির সম্বলিত ঢিবিটি চারপাশের ভূমি থেকে প্রায় ২.৫ মিটার উঁচু। উভয় মন্দিরই আবদ্ধ কক্ষ তৈরি করে তার মাঝে নির্মিত হয়েছে। এই ধরনের স্থাপনারীতি সেলুলার স্থাপনারীতি হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের নিকটবর্তী ভরতভায়না, মনিরামপুরের দমদম পীরস্থান ঢিবি ও ঝুড়িঝাড়া ঢিবিতে উন্মোচিত স্থাপত্যকাঠামোতেও একই রীতি লক্ষ্যণীয়।
বিহারটি উত্তর-দক্ষিণে ৬০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯০ মিটার। বিহারের আঙ্গিনার (courtyard) পরিমাপ ৩৪.৫ মি. (উত্তর-দক্ষিণে) ও ৪০.৬ মি. (পূর্ব-পশ্চিম)। বিহারের ভেতরের দিকের এখন অব্দি উন্মোচিত দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহু সংলগ্ন বারান্দার পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ৪২ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৪৪.৬ মিটার। ভিতরের এই বারান্দার প্রস্থ ২.৪০ মিটার – ২.৫৫ মিটার। দক্ষিণ বাহু সংলগ্ন বাইরের বারান্দার প্রস্থ ৪.৫০ মিটার। পশ্চিম দিকের বাইরের এবং প্রবেশপথ সংলগ্ন বারান্দা বা পরিসরের প্রস্থ হলো ৪.৭৫ মিটার। এই বারান্দা গিয়ে দক্ষিণ বাহুর বারান্দার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রবেশদ্বারের অভিক্ষেপ: পশ্চিমবাহুর মাঝ বরাবর ৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৬৫ মিটার প্রস্থ সম্বলিত প্রবেশপথ উন্মোচিত হয়েছে। প্রবেশপথের অভিক্ষেপের শেষসীমা এখনো অব্দি চিহ্নিত করা যায়নি। কারণ তা সংলগ্ন শস্যবিশিষ্ট জমির মধ্যে প্রসারিত হয়েছে।
বিহারের কক্ষ: বিহারের উত্তর বাহুতে ২টি, দক্ষিণ বাহুতে ৯টি এবং পশ্চিম বাহুতে এখনো পর্যন্ত ৭টি কক্ষ (Cell) উন্মোচিত হয়েছে। পশ্চিমবাহুর মাঝখানের কক্ষটি বড় এবং প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং এই কক্ষের পশ্চিমেই অভিক্ষেপটি যুক্ত হয়েছে। উন্মোচিত কক্ষগুলোর পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ৫.২৩ মি. থেকে ৪.৭১ মি. এবং প্রস্থে ৪.৬১ থেকে ৪.১৭ মি. পর্যন্ত। মধ্যবর্তী সেলের পরিমাপ ১.৯৮ মি. থেকে ২.০৮ মি.। কক্ষগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথককারী পরিসরের পরিমাপ হলো ৪৫ সেমি থেকে ১৬৫ সেমি।
বিহারের উত্তরবাহু ও বিহারাঙ্গনের বেশিরভাগ স্থান এখনো খনন করা যায়নি। কারণ সেখানে বিভিন্ন শস্য রয়েছে। পানের বরজ ও মেহগনী বাগান রয়েছে। পূর্বদিকের মন্দিরদুটো ছাড়া বাকি অংশে ঢিবি কেটে প্রায় সমান করে চাষাবাদ করা হয়েছে। ফলে ঢিবির মধ্যে চাপা পড়া স্থাপত্যিক অবশেষের উপরের দিকের কাঠামো আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ইট তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণে।